করোনার প্রভাবে দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলে চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িত কয়েক লাখ চাষী, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। চিংড়ি উৎপাদনের এক মৌসুমের শুরুতে ঘেরে চিংড়ির পোনা ছাড়তে না পারায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে চাষীরা।
ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন তারা। করোনার কারণে সব সেক্টরের সাথে চিংড়ি সেক্টরও হুমকীর মুখে পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে, নতুন বাজার সৃষ্টিসহ ঘুরে দাড়াবার সম্ভাবনার দাবি করেছেন বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় আশির দশক থেকে কয়েক লাখ চাষি বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ করে আসছেন। এই অঞ্চলে চিংড়ি চাষ লাভজনক হওয়ায় সাদা সোনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যার ফলে দিন দিন চাষীর সংখ্যা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই চিংড়ি শিল্প থেকে সরকারের বিপুল পরিমান রাজস্ব আসে। বাগেরহাট জেলায় ৬৬ হাজার ৭‘শ ১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬‘শ ৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংিড়ির ঘের রয়েছে।
এসব ঘেরে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১৬ হাজার ৫‘শ ৭৫ মে.টন বাগদা ও ১৫ হাজার ৪‘শ ১৩ মে.টন গলদা উৎপাদন হয়েছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সিংহভাগ উৎপাদন না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে জেলার হাজার হাজার কোটি টাকা আয় কমে যাবে। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এ বছর চিংড়ির রেনুপোনা উৎপাদন বন্ধ থাকায় চাষীরা ঘেরে পোনা ছাড়তে পারছেন না।
অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক খাল খননের জন্য খালগুলো বন্ধ রয়েছে। যার ফলে ঘেরে পানি উঠতে না পাড়ায়, মরার উপরে খারার ঘায় পরিনত হয়েছে। এছাড়া রপ্তানি আমদানি বন্ধ থাকায় ও বাজারে মাছের দাম কমে যাওয়ায় সবকিছু যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। জন শুন্য মৎস্য আড়তগুলো খাঁ খাঁ করছে। গেল বছরের তুলনায় এবার চিংড়ি উৎপাদন ২৫ শতাংশে নেমে আসার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মৎস্য চাষীরা বলছেন, দেশে এক ধরণের দূর্ভিক্ষ চলছে। দক্ষিনাঞ্চলের অনেকেই মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। আমরা ঘেরে মাছ বিক্রিও করতে পারছি না। আবার নতুন করে ঘেরে মাছও ছাড়তে পারছি না। ওদিকে পাওনা দাররা টাকার জন্য তাগেদা দিচ্ছেন।
মৎস্য চাষী ফখরুল ইসলাম বলেন, চিংড়ি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু এ বছর যখন চিংড়ি মাছ বিক্রি র সময় তখনই করোনা‘র প্রভাবে মাছ ক্রয় বন্ধ রয়েছে। আবার ঘেরে পোনা ছাড়ারও সময় এসেছে। এখন পানিও নেই। ঘেরের বিক্রি উপযুক্ত মাছের দাম নেই, পোনার দাম আকাশ চুম্বি। কি যে হবে আমাদের।
চিংড়ি ব্যবসায়ী লিটন পরামানিক বলেন, করোনার প্রভাবে বিদেশে মাছ রপ্তানি বন্ধ। দেশের বাজারেও মাছের তেমন ক্রেতা নেই। কারণ বাগেরহাট থেকে অন্য কোথাও মাছ পাঠানোর সু ব্যবস্থা নেই বর্তমানে। আমরা এক ধরণের বেকার অবস্থায় রয়েছি। অতিদ্রুত দেশ ও বিদেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমাদের না খেয়ৈ মরতে হবে।
রামপাল উপজেলার ফয়লাহাট চিংড়িপোনা মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি কাজী রাশেদুল ইসলাম ডালিম বলেন, রামপালে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৮৩টি খাল খনন করার জন্য ঘেরে পানি উঠাতে না পাড়ায় একটা সিজন মার খেয়েছি। পাশাপাশি করোনা ভাইরাসের কারণে রপ্তানি বন্ধ থাকায় চিংড়ি চাষী ও ১৩৫ টি আড়তের ব্যবসায়ীরা বেকার হয়ে পড়েছে।
চিংড়ি গবেষনা কেন্দ্র, বাগেরহাটের উর্দ্ধোতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এইচ এম রাকিবুল ইসলাম বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে শুধু চিংড়ি সেক্টর নয় সকল সেক্টরেই একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমরা আশা করছি করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের মৎস্য সেক্টর একটি বড় সম্ভাবনার খাতে পরিনত হবে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, খাল খননের ফলে ঘেরে পানি নেই। বিক্রয়যোগ্য মাছের দাম নেই। বাজারে পোনা সংকট। বাগেরহাটে প্রায় দেড় কোটির মত পোনার চাহিদা রয়েছে। এ বছর ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ পোনা বাজারে পাওয়া যাবে। কোন ভাবেই পোনার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তবে মহামারি থেকে দেশ পরিত্রাণ পেলে চাষীদের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।