ঃ মোহাম্মদ গোলাম হোসেন ফারহান ঃ
গত একযুগ ধরে অবকাঠামো উন্নয়ন কিংবা নির্মাণ শিল্পের জন্য বাংলাদেশে চলছে এক সোনালী অধ্যায়। পদ্মাসেতু, থ্রি ব্রীজ,মেট্রো রেল,রূপপুর-রামপাল-মাতারবাড়ি সহ বেশ কিছু পাওয়ার প্ল্যান্ট, কর্ণফুলী টানেল,পায়রা পোর্ট, এয়ারপোর্ট থার্ড টার্মিনাল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, ভাসানচর প্রকল্প সহ বেশ কিছু ফ্লাইওভার,পানি শোধনাগার, রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন সব মিলিয়ে প্রায় গোটা ৫০ এর মত মেগা প্রজেক্টের কাজ চলছে কিংবা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।এর প্রভাবে প্রজেক্ট সংলগ্ন এলাকা কিংবা জেলার মানুষেরও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি হচ্ছে অবকাঠামো গত উন্নয়নেরও কাজ।
২০১১ সালেও যেখানে বাংলাদেশে সিমেন্টের চাহিদা ছিল ১.৫ কোটি মেট্রিক টন সেখানে ২০১৯ সালে এই চাহিদা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩.৫ কোটি, এমনকি কোভিডের বছরও বিক্রি হয়েছিলো প্রায় ৩.৪ কোটি মেট্রিক টন। আমার ধারণা,২০২১ এ এটি ৩. ৭ কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। অর্থাৎ মাত্র ১০ বছরে সিমেন্টের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুনেরও বেশি।
রডের মার্কেটের তো আরও রমরমা অবস্থা,২০১১ সালে যেখানে রডের চাহিদা ছিলো প্রায় ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন,সেখানে ২০১৯ এ এটি দাঁড়ায় প্রায় ৫৫ লক্ষ মেট্রিক টনে, এমনকি পেনডেমিকের বছরেও বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৯.৩ লক্ষ মেট্রিক টন, যা ২০২১ এ ৬০ লক্ষ্য মেট্রিক টনেরও বেশি হওয়ার সম্ভবনা আছে। অর্থাৎ ১০ বছরে রডের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন গুন্।
চাহিদা বাড়লেও,আমরা যদি মার্কেট শেয়ারের দিকে তাকাই,তখন মনে হবে একধরণের শ্রেণী বৈষম্যের সৃষ্টি হয়ে গেছে রড-সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে।বাজার হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রড-সিমেন্টের মার্কেট শেয়ারের বর্তমান যে চিত্র আমি আঁকতে পেরেছি তা অনেকটাই এরকম….
ব্র্যান্ডের নাম | মার্কেট শেয়ার |
বিএসআরএম | ২৪.৫৭% |
একেএস | ২০.৯১% |
কেএসআরএম | ৭.৮১% |
জিপিএইচ ইস্পাত | ৫.০৩% |
রহিম স্টিল | ৩.৯৭% |
আনোয়ার ইস্পাত | ৩.৩৬% |
অন্যান্য ২০টি রিবার ফ্যাক্টরি | ৩৪.৩৫% |
৬টি ব্র্যান্ডের হাতে রডের বাজারের ৬৫.৬৫% শেয়ার |
তথ্য সূত্র: মার্কেট হতে প্রাপ্ত | |
ব্র্যান্ডের নাম | মার্কেট শেয়ার |
শাহ | ১৩.২১% |
বসুন্ধরা + কিং ব্র্যান্ড | ১১.৫৭% |
ফ্রেশ +মেঘনাসিম | ৮.৬২% |
লাফার্জ-হোলসিম | ৭.২৭% |
সেভেন রিং | ৭.১৮% |
ক্রাউন | ৬.৮৭% |
প্রিমিয়ার | ৫.৮১% |
স্ক্যান +রুবি | ৫.৩৭% |
আকিজ | ৪.৬২% |
বেঙ্গল | ২.৫৫% |
অন্যান্য ২৪ টি সিমেন্ট ব্র্যান্ডের | ২৬.৯৩% |
১০টি কোম্পানির দখলে সিমেন্ট বাজারের ৭৩.০৭% শেয়ার |
তথ্য সূত্র: মার্কেট হতে প্রাপ্ত | |
তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে,বাজারের ছোট ছোট কোম্পানি গুলোর অবস্থা কতটা নাজুক।এবং এই অবস্থা দিন দিন আরও বেশি নাজুকের দিকে যাচ্ছে।২০১৯ সালে প্রথম ৬টি রিবার কোম্পানির মার্কেট শেয়ার ছিল ৬১.১২% এবং প্রথম ১০ টি সিমেন্ট কোম্পানির মার্কেট শেয়ার ছিল ৭২.৬২% .. উভয় জোটেরই মার্কেট শেয়ার গত বছর বেড়েছে। কোভিড ইফেক্টের কারণে ২০২০ রডের মার্কেটে বিক্রি কম ছিল ১০.৪৬% আর সিমেন্ট মার্কেটে এর প্রভাব ছিল -২.৭% এর মতো।
২০২১ এ আমার ধারণা বাংলাদেশের মার্কেটে অন্তত ৬০ লক্ষ টন রড বিক্রি হবে আর সিমেন্টের বিক্রি বেড়ে দাড়াবে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ টনে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটুকু প্রস্তুত আছে ছোট কোম্পানিগুলো। হয়তো অনেকেই ভাবছেন,ন্যাশনাল সেলস বাড়লে সবারই বিক্রি ভালো হবে। এইটা একটা ভুল ধারণা। বাংলাদেশের সর্বমোট রিবার-রড উৎপাদন ক্ষমতা আছে ৭৮.৩ লক্ষ টন যার ৬৬.২৮% ই উৎপাদন করে প্রথম ৬টি কোম্পানি। সিমেন্টের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৬ কোটি টনের মধ্যে ৭২.৬৮% ই প্রথম ১০ টি সিমেন্ট কোম্পানির সামর্থের মধ্যে।
এমতবস্থায়,ছোট কোম্পানিগুলো যদি তাদের কৌশলের পরিবর্তন না আনে,তাহলে অদূর ভবিষ্যতে তারা আস্তে আস্তে এক এক করে বিলীন হয়ে যাবে।
যেসব ইমিডিয়েট একশন এখনই অপেক্ষাকৃত ছোট কোম্পানিগুলোর নেয়া দরকার মার্কেটে টিকে থাকার জন্য,তারমধ্যে কিছু নিচে আলোচনা করা হলো:
১)কোয়ালিটি নিয়ে কাজ করা:
এখানে কোয়ালিটি বলতে তিনটি জিনিসকে বুঝানো হয়েছে, প্রোডাক্ট কোয়ালিটি , ব্র্যান্ড কোয়ালিটি আর এমপ্লয়ি কোয়ালিটি। এই তিনটি কোয়ালিটি নিয়ে একই সাথে কাজ করতে হবে। আমরা দেখছি কনজিউমাররা এখন ভালো প্রোডাক্ট কিনছে , প্রোডাক্টের কোয়ালিটির ব্যাপারে এক চুলও ছাড় এখনকার ক্লাইন্টরা দিচ্ছেন না। কনস্ট্রাকশন কোম্পানি-ইঞ্জিনিয়াররা ভালো ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছেন আর এই কঞ্জিউমারদের মেইনটেইন করার জন্য দরকার গুনগত মানের এমপ্লয়ি।
এখনো অনেক কোম্পানির সেলসের জি,এম আছে যারা ঠিকমতো একটা ইমেইল লিখতে পারেন না , মার্কেট সম্পর্কে ক্লিয়ার আইডিয়া নেই। তাদের শুধু একটাই যোগ্যতা তারা শুধু ডিলার চিনে। শুধু মাত্র ডিলারদের উপর ভর দিয়ে ব্যবসা করলে যে ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়েনা তার জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে দাউ দাউ করে জ্বলছে বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি গ্রূপের রড-সিমেন্ট দুইটি পণ্যই।
অতএব,৩৬০ ডিগ্রী কোয়ালিটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
২)কাজের পরিবেশ ভালো করতে হবে:
কেন ছোট কোম্পানি গুলোতে গুণগত মানের লোক বেশিদিন চাকরি করেন না ? তার একমাত্র কারণ হলো এসব কোম্পানির সনাতন পদ্ধতিতে কাজের পরিবেশ, বেতন বাদে আর বাড়তি কোন সুযোগ সুবিধা না থাকা ,আর নোংরা অফিস পলিটিক্সের ফলে চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা।
কোম্পানির মালিকদের ব্যবসার স্বার্থে কাজের পরিবেশ,সুযোগ সুবিধা আরো বেশি বাড়াতে হবে। তাদের কে আরো বেশি এগ্রেসিভ হতে হবে রেইসে টিকে থাকার জন্য।
৩)প্রয়োজনে জোনাল হয়ে যেতে হবে অথবা সমমনাদের সাথে ব্যাবসা সংযুক্ত বা মার্জ করতে হবে:
আপনার কোম্পানির প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি কম, কিন্তু আপনি খেলতে চাচ্ছেন সব মার্কেটে। এইটা কখনোই হতে পারেনা। সব মার্কেটেই তাহলে আপনি অবহেলিত অবস্থায় থাকবেন।আপনার মার্কেট শেয়ারগুলো ১% এর নিচে থাকতে থাকতে এক সময় ০% এ চলে আসবে। অতএব,যেই কয়টি মার্কেটে আপনার ব্র্যান্ডের অবস্থা ভালো আপনি সেখানেই ধীরে ধীরে শক্তি সামর্থ বাড়ান, প্রয়োজনে জোনাল হয়ে যান. বাংলাদেশে কয়েকটি রড-সিমেন্ট কোম্পানি আছে যারা শুধু মাত্র রিজিওনাল মার্কেটে খেলে বেশ ভালো করছে।
কোম্পানির বৃহৎ স্বার্থের জন্য সমমনা কোম্পানির সাথে মার্জ হয়ে যেতে পারেন। বাংলাদেশের মার্কেটকে ভাগ করে নিতে পারেন। দেখেন লাফার্জ-হোলসিম মার্জ করার পরে আজকে কত ভালো অবস্থায় আছে ওরা। বিদেশিরা যা আগে থেকে বুঝতে পারে তা আমরা বুঝেও অনেক সময় বুঝিনা।আমি হলফ করে বলতে পারি, রি ইনভেস্টমেন্ট ছাড়া ছোট কোম্পানি গুলোর এই মুহূর্তে মার্কেটে টিকে থাকার এক মাত্র উপায় মার্জ এন্ড জোনাল ডিভাইডেশন।
রডের ২০ টি কোম্পানির মধ্যে কয়েকটিরই ফ্যাক্টরি বিক্রি করার কথা বার্তা চলছে। এক সময় ৪৬টি সিমেন্ট কোম্পানি হয়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশে তা এখন কমতে কমতে ৩৪ টি তে এসে থেকেছে। এর মধ্যে শুনা যাচ্ছেই কয়েকটি বড় বড় প্রতিষ্ঠান রড উৎপাদনে আসছে খুব শিগগিরই,সিমেন্টেও কেউ কেউ প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি বৃহৎ থেকে বৃহদাকার করবে।
অতএব, মার্কেটের ছোটদের এখনই সময় আরেকবার ভাবা, কোথায় যাচ্ছে ভবিষ্যৎ ? আর কি হবে তাদের পরিকল্পনা ?
লেখক: মোহাম্মদ গোলাম হোসেন ফারহান ঃ (বি-এস-সি ইন সিভিল (আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়), এম,আই,ই,বি এম-বি-এ ইন মার্কেটিং (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সিনিয়র বিজনেস ডেভেলপম্যান্ট টিম মেম্বার,কেএসআরএম স্টিল প্ল্যান্ট লিমিটেড। ফর্মার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট টিম মেম্বার-ডোরিন গ্রূপ এন্ড আনোয়ার গ্রূপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ।)
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব যা সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয় ।)