গত জুন মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৯৭ টি। নিহত ৩৬১ এবং আহত ৩৪৮ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৫৭, শিশু ৩২। এককভাবে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। ১০৩ টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৯৪ জন, যা মোট নিহতের ২৬.০৩ শতাংশ। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৪.৬৮ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৭৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১.০৫ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৪৯ জন, অর্থাৎ ১৩.৫৭ শতাংশ।
এই সময়ে ১১ টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৫৬ জন নিহত এবং ২৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন। ৬টি রেল দুর্ঘটনায় নিহত ৭ জন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্টনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
দুর্ঘটনায় ট্রাক যাত্রী ২৩, বাস যাত্রী ১২, পিকআপ যাত্রী ১০, কাভার্ডভ্যান যাত্রী ২, মাইক্রো যাত্রী ৯, প্রাইভেটকার যাত্রী ১১, এ্যাম্বুলেন্স যাত্রী ৪, লরি যাত্রী ৩, সিএনজি যাত্রী ১২, ইজিবাইক-অটোরিকশা যাত্রী ৩৫, নসিমন-করিমন যাত্রী ২৩, ভটভটি-আলমসাধু যাত্রী ২৫, রিকশা ও রিকশাভ্যান যাত্রী ১৬ এবং বাই-সাইকেল আরোহী ৬ জন নিহত হয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে ৮জন শিক্ষক, ১জন শিক্ষা কর্মকর্তা, ১জন প্রকৌশলী, ২জন স্বাস্থ্যকর্মী, ১জন পুলিশ সদস্য, ১জন গ্রাম পুলিশ সদস্য, ১জন বিজিবি সদস্য, ১জন ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার, ২জন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ৪জন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, ২জন ব্যাংকার, ১১ জন স্থানীয় ব্যবসায়ী, ৮জন পোশাক শ্রমিক, ৩জন এনজিও কর্মী, ১৯জন সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী এবং ৪৩ জন শিক্ষার্থী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩১টি (৪৪.১০%) জাতীয় মহাসড়কে, ৯২টি (৩০.৯৭%) আঞ্চলিক সড়কে, ৫৩টি (১৭.৮৪%) গ্রামীণ সড়কে এবং ২১টি (৭.০৭%) শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাসমূহের মধ্যে ৬৩টি (২১.২১%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৮৮টি (২৯.৬২%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৭৮টি (২৬.২৬%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা, ৫৯টি (১৯.৮৬%) যানবাহনের পেছনে আঘাত এবং ৯টি (৩.০৩%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়ী, ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৮.৭৪ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ৪.৪২ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-জীপ-এ্যাম্বুলেন্স ৪.৬৬ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ৭.১২ শতাংশ, মোটর সাইকেল ২৫.৩০ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা) ৯.৫৮ শতাংশ, নসিমন-করিমন-ভটভটি-আলমসাধু ১২.৫৩ শতাংশ, রিকশা-বাই-সাইকেল ৫.৬৫ শতাংশ এবং অন্যান্য (টমটম, পাওয়ারটিলার, ধান মাড়াইয়ের মেশিন গাড়ি) ১.৪৭ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা ৪০৭ টি। (ট্রাক ৮১, বাস ২৯, কাভার্ডভ্যান ১৩, পিকআপ ২২, লরি ৬, ট্রলি ৭, ট্রাক্টর ৬, মাইক্রোবাস ৬, প্রাইভেটকার ৯, এ্যাম্বুলেন্স ৩, বিজিবি পিকআপ ১, আনছার ব্যাটেলিয়ান জীপ ১, পোশাক শ্রমিক বহনকারী বাস ১, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাস ১, পাওয়ারটিলার ১, ধান মাড়াইয়ের মেশিন গাড়ি ১, মোটর সাইকেল ১০৩, বাই-সাইকেল ৬, নছিমন-করিমন ২৪, ভটভটি-আলমসাধু ২৭, ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা ৩৯, টমটম ৩ এবং রিকশা ১৭টি।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৭.৪০%, সকালে ২৮.৬১%, দুপুরে ২২.৫৫%, বিকালে ১৭.৮৪%, সন্ধ্যায় ৮.৭৫% এবং রাতে ১৪.৮১%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে ২১.৫৪%, রাজশাহী বিভাগে ২০.৫৩%, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪.৪৭%, খুলনা বিভাগে ১০.৭৭%, বরিশাল বিভাগে ১০.৪৩%, সিলেট বিভাগে ৩.৭০%, রংপুর বিভাগে ১০.১০% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৮.৪১% দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। ৬৪টি দুর্ঘটনায় ৮১ জন নিহত। কম সিলেট বিভাগে। ১১ টি দুর্ঘটনায় নিহত ১২ জন। একক জেলা হিসেবে ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৫টি দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত। সবচেয়ে কম পিরোজপুরে। ১টি দুর্ঘটনায় ১ জন নিহত।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ:
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশমালা তৈরির চক্র থেকে বেরিয়ে টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা পোষণ করতে হবে।
মন্তব্য: গত মে মাসের তুলনায় জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি উভয়ই বেড়েছে। মে মাসে ২১৩টি দুর্ঘটনায় ২৯২ জন নিহত হয়েছিলেন। এই হিসাবে জুন মাসে দুর্ঘটনা ৩৯.৪৩% এবং প্রাণহানি ২৩.৬৩% বেড়েছে। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ২৭৭ জন, অর্থাৎ ৭৬.৭৩%। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ বিষয়ক পদক্ষেপ সমূহের মধ্যে একমাত্র জনসচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া অন্য সকল বিষয় প্রাতিষ্ঠানিক, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের এবং এর সাফল্য নির্ভর করে গণপরিবহন খাতের সুশাসনের উপর। তাই, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন মনে করে, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধ বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।