বাংলার কৃষক মানে আলোকিত সোনার মানুষ, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশ খাদ্যে ভরপর, সবকিছু আমদানি নির্ভর হলেও আলু ধানের তেমন ঘাটতি নেই, বিগত আলু মৌসুমে যে সব চাষিরা অধিক লাভের আসায় হিমাগারে রেখেছিলেন তাদেরকে গুনতে হয়েছে প্রচুর লোকসান, তাই বলে থেমে গেলে তো হয়না, পুনরায় এমৌসুমে দ্বিগুন খরচ সেই সাথে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে আলু রোপন করে পুরোদমে চলছে পরিচর্যার কাজ। চাষের জন্য সার কিনতে হয়েছে বাড়তি দামে, জমি লীজ নিতে হয়েছে বেশি টাকায়, এজন্য উত্তোলন পর্যন্ত কেজি প্রতি ১২ টাকার ঊর্ধ্বে খরচ হচ্ছে বলে দাবি চাষিদের। সার সিন্ডিকেটের আগে সরকারী ভাবে রোপন থেকে উত্তোলন কেজি প্রতি ৭ টাকার নিচে ছিল। বরেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত কৃষি ভান্ডার নামে খ্যাত দেশ জুড়ে পরিচিত রাজশাহীর উত্তরে তানোর উপজেলাটি। এই উপজেলার মাটি কৃষি ফসল উৎপাদনে সোনার চেয়েও খাটি। প্রচুর পরিমানে ধান আলু চাষ হয়। বরাবরের মত আলুর লক্ষমাত্রা সঠিক হলেও চলতি মৌসুমে সরিষা চাষ হয়েছে চোখে পড়ার মত। এউপজেলা রয়েছে স্বর্ন পদক পাওয়া স্বশিক্ষিত কৃষি বিজ্ঞানী ও পরিবেশের উপর পদক প্রাপ্ত কৃষক। রয়েছে বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক, যেখানে হারিয়ে যাওয়া দুইশতাধিক ধানের বীজ সংরক্ষন করা আছে। উপজেলার দিগন্ত মাঠ জুড়ে আলুর সবুজ পাতা। দেখে মনে হবে সবুজ চাদরে মাঠ বিছিয়ে রেখেছেন কৃষকরা। এদিকে উপজেলায় পাচটি হিমাগারে পর্যাপ্ত আলু মওজুদ রয়েছে। অনেকেই বিক্রির চিন্তা বাদ দিয়ে কোমর বেধে চলতি মৌসুমের আলু পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কালিগঞ্জ এলাকার কৃষক ভবেশ জানান, লাভের আসায় প্রায় ১৩০০ বস্তা আলু কিনে তামান্না হিমাগারে রেখেছিলা। কয়েকদিন আগে ৬ টাকা কেজি দামে বিক্রি করেছি। হিমাগারের খরচ বাদ দিয়ে ১ টাকা ৫০ পয়সা কেজি করে মুলধন পেয়েছি। লোকসান তো দূরে থাক একথা মনে পড়লে হতাশ হয়ে চিন্তায় কপাল ভাজ হয়ে পড়ছে। এত পরিমান লোকসান কিভাবে পুরন করব, নাকি পালিয়ে যাব, মহা টেনসনে দিনপার করছি।
জানা গেছে, উপজেলার প্রায় ধানী মাঠে আলু চাষ হয়ে থাকে। কয়েক দিন ধরে ঠান্ডা ভালো হওয়ায় আলু গাছ বেরিয়েছে চোখে পড়ার মত। গত মৌসুম ও চলতি মৌসুমে আলুর চাষ অনেকটায় কম হয়েছে। কারন সার নিয়ে চলেছে মহা সিন্ডিকেট। দ্বিগুণ দামে পটাশ ও ডিএপি সার কিনতে হয়েছে কৃষকদের। মুলত এজন্যই কম হয়েছে চাষাবাদ।
চাষী মাহাম জানান, গত মৌসুমে ৯ বিঘা আলু চাষ করে জমি থেকে দেড় বিঘা জমির আলু ১১ টাকা ৫০ পয়সা কেজি দরে বিক্রি ও বাকিগুলো রহমান হিমাগার-২ রাখা হয়েছিল। মাঝে ১৯ টাকা কেজি করে বিক্রি করি ও পরে আরো কিছু বিক্রি করি। সবমিলে ৯০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। সেই বোঝা মাথায় নিয়ে পুনরায় ১১ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি। যার বয়স ২৭ দিন হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় গাছ ভালো হয়েছে। লোকসানের অন্যতম কারন হিমাগারে প্রচুর পরিমান আলু পচেছে। তার ভাই হাবিব গত মৌসুমে ২০ বিঘা আলু চাষ করে সবই রহমান হিমাগার-১ রাখা হয়। লোকসান প্রায় ২ লাখ টাকার বেশি। লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে লাভের আসায় চলতি মৌসুমেও ২০ বিঘা আলু চাষ করেছি, এখন পর্যন্ত কোন রোগ বালা নাই, গাছের চেহারা ভালো হয়েছে। কিন্ত খরচ প্রচুর, কি হবে বলা কষ্টকর।
চাষী জাহাঙ্গীর গত মৌসুমে ৬০ বিঘা জমিতে আলু রোপন করে পুরোটায় রহমান হিমাগার -২ রাখা হয়। কিন্তু লাভ তো দুরে থাক ১০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। সেই লোকসান কাটিয়ে লাভের আসায় ৮০ বিঘা জমিতে চাষ করা হয়েছে।
গত মৌসুমে উপজেলায় প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হলেও চলতি মৌসুমে কমে ১৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।
একাধিক চাষীরা জানান, আলুর মৌসুম এলেই রাজত্ব বাড়ে সিন্ডিকেট চক্রের। সার নিয়ে ডিলারদের, জমি নিয়ে গভীর নলকুপের অপারেটরদের চলে সিন্ডিকেট। জমি থেকে যদি আলু কিনে ১২ টাকা কেজি সেই আলু বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে। অথচ যে কৃষক কনকনে শীত উপেক্ষা করে ফসল ফলায় সে কৃষক ন্যায্য দাম পায় না। এই আলু যদি আমদানি করা লাগতো তাহলে কি পরিমান সিন্ডিকেট হত সেটা বাজার ব্যবস্থা বলে দেয়। যেই কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেই কৃষকদের ফসলে কেন সিন্ডিকেট হবে। কৃষকদের লোকসানের অন্যতম কারন হিমাগারে আলু পচে যাওয়া ও চুরি হওয়া। দোহায় জালানি সংকট। কিন্তু তারা যে পরিমান আলু রাখতে পারবে তার কয়েকগুণ বেশি রাখার কারনে হয়েছিল পচেছে। প্রতিটি হিমাগারে আলু পচলেও রহমান-১-২ তে ব্যাপক পচে চুরি হয়। আবার রহমান হিমাগার -২ এ গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ গরুর খামার। যার বর্জ্য দুর্গন্ধ ছড়িয়ে কৃষকের ফসলহানি ঘটছে। ছড়িয়ে পড়েছে প্রচুর দূর্গন্ধ। হিমাগার কর্তৃপক্ষের খাম খেয়ালীতেই শতশত কৃষক পথে বসেছে। তারপর চাষাবাদ করা হয়েছে যদি লোকসান থেকে উঠা যায়, আর দাম না পেলে পথের ফকির হতে হবে। চাষাবাদ ছাড়া উপায় নেই। দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক হিমাগার থেকে আলু বের করেন নি। বিভিন্ন এনজিও ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে চাষাবাদ করা হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার সাইফুল্লাহ আহম্মেদ জানান, আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় আলুর গাছ হয়েছে ভালোই। এখন পর্যন্ত রোগ বালাইয়ের খবর পাওয়া যায়নি। সার্বক্ষনিক মাঠে থাকা হচ্ছে। গত বুধবারে উপজেলার পাঁচ হিমাগারে তথ্য নিয়ে জানা যায় প্রায় ২০০ মে: টন আলু মওজুদ রয়েছে।