করোনা দুর্যোগের ফলে জীবন-জীবিকা পুনরুদ্ধার ও পুর্নবাসনে প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষিখাতে ‘বিশেষ মনোযোগ’ প্রত্যাশা থাকলেও বাজেট বরাদ্দের দিক থেকে পূরণ হয়নি বলেই মনে করছে খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি), বাংলাদেশ। একই সাথে এই বাজেটে করোনাসৃষ্ট ক্ষতি ও জীবিকায়ন সুরক্ষা, ভেঙে যাওয়া কৃষি বিপণন ব্যবস্থা পুনগঠনে কোন সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা যেমন নেই,তেমনিভাবে অর্থ বরাদ্দের দিক থেকেও বাজেটের গড় প্রবৃদ্ধি তুলনায় কৃষি ও তৎসংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ কমেছে।
এছাড়াও, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষকেদর জন্য ৫০০০ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা এবং ক্ষুদ্র ও আয়ের কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের ৩০০০ কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা করা হলেও জমির কাগজ, লোন ট্রাক-রেকর্ড না থাকা ইত্যাদি কারণে একই সাথে এই প্রণোদনা থেকে বর্গাচাষী, অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষি কাজ করেন এমন কৃষকরা কোন সহায়তা পাবেন না। ফলে, এই প্রণোদনা ক্ষুদ্র-প্রান্তিক এবং বর্গাচাষীদের জন্য জনপরিসেবায় অভিগ্যমতার বৈষম্য এবং সামগ্রিকভাবে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি করবে। এটি প্রান্তিক কৃষকদের আরও প্রান্তিক এবং ধনী কৃষকদের আরো ধনী করবে।
আজ ২০ জুন, শনিবার বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) আয়োজিত ‘জনপর্যালোচনা: কৃষি-বাজেট ২০২১’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উঠে আসে।
খানি বাংলাদেশের সভাপতি ড. মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে ও দৈনিক কালের কণ্ঠের খুলনা ব্যুরো প্রধান গৌরাঙ্গ নন্দীর সঞ্চালনায় এই ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে, প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনির্ভাসিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলম খান, আলোচনায় অংশ নেয় গণতান্ত্রিক বাজেট আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার মোস্তফা, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সাহানোয়ার সাইদ শাহীন, প্রতিবেশ ও প্রাণ-বৈচিত্র বিষয়ক গবেষক পাভল পার্থ ও খানির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ। সংবাদ সম্মেলনে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খানির অ্যাডভোকসি সমন্বয়কারী সালমা আহমেদ।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. জাহাঙ্গীর আলম কৃষি বাজেটের ঘাটতির জায়গাগুলো উল্লেখ করে বলেন, ‘ এই মুহূর্তে গ্রামীণ মানুষের হাতে নগদ প্রয়োজন। বাজেটে যদি সরকার প্রত্যেক কৃষককে ২০০০ করে নগদ সহায়তা বরাদ্দ দিতে পারতো, তাহলে সেটি আগামী মওসুমে চাষাবাদ এবং কৃষকদের জীবিকায়ন সুরক্ষায় কাজে লাগতো। বাজেটে কৃষি যান্ত্রীকিকরণের বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে সবার জন্য এই ভর্তুকি উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। একটি উন্নয়নশীল দেশ কৃষিখাত থেকে জিডিপি আয়ের ১০% ভর্তুকি দিতে পারে। পেঁয়াজ আমদানীতে ৫% ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশীয় পেঁয়াজ চাষিদের ন্যাযূমূল্য নিশ্চিত করতে এটা ২০% করা দরকার।
করোনাকালীন এই কৃষি বাজেট কতটা কৃষি ও কৃষক সহায়ক হয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সাহানোয়ার সাইদ শাহীন। তিনি বলেন, ‘দেশে কৃষিকাজ-ফিসারিজ-লাইফস্টক মিলিয়ে দেশে ১ কোটি কৃষি পরিবার আছে। যার মধ্যে ৬৫ লাখ পরিবারেরই নিজস্ব জমি নেই। এরা সবাই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। আরও একটি ব্যাপার হলো, এবারের মোট বোরো উৎপাদনের ৮৫% এসেছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাধ্যমে। তাছাড়া এবারের কৃষি বাজেটে যা এসেছে,প্রায় সবই অতীতে ছিল। নতুন হলো ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ। তবে স্বল্পসুদের এই ঋণ পেতে হলে জমির মালিককে দলিল দেখাতে হবে।
বর্গাচাষিকে দেখাতে হবে মালিকের সাথে চুক্তিপত্র। কিন্তু দেশের কৃষিব্যবস্থা এখনও ততটা উন্নত নয় জমি বর্গা নিতে গেলে চুক্তিপত্র রাখবে। এরপর আসছে নারী কৃষক। গত ১০ বছরে নারী কৃষকের সংখ্যা বেড়েছে ৭০ লাখ। যেখানে প্রতি বছর ২ লাখ পুরুষ পেশা পরিবর্তন করছে। অর্থাৎ, দেশের কৃষি সম্পূর্ণভাবে নারীকেন্দ্রিক। এই অবস্থায় কৃষিতে নারীর স্বীকৃতি প্রদান প্রয়োজন, সরকারের জনপরিসেবাগুলোতে নারী কৃষকদের অভিগম্যতা বাড়ানো প্রয়োজন, তা না হলে আমাদের কৃষি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
বাজেটে করোনাকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষিতে নানান উদ্যোগের নির্দেশনা এবং সম্ভাবনা থাকলেও, কৃষকদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে কোন নির্দেশনা না থাকাটা হতাশার বলে উল্লেখ করেন প্রতিবেশ ও প্রাণ-বৈচিত্র বিষয়ক গবেষক পাভল পার্থ। তিনি বলেন, ‘বাজেটে এবার কৃষিখাতে এবার বেশি বরাদ্দ রাখায় সরকারকে ধন্যবাদ। কিন্তু কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারটি একেবারে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া করোনাকাল কৃষিতে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হয়েছে তা হলো বীজের অভাব।
এমন অবস্থায় দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে, পাড়ায় বীজ ব্যাংক তৈরি করা জরুরী। আর এটা করতে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে নারীরা। তাই নারী কৃষকদের গুরুত্ব অনেক বেশি। এছাড়া আম্ফানের মতো দুর্যোগ, কিংবা অন্যান্যা যেসব এলাকায় কৃষির অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়েছে, সেসব এলাকায় বরাদ্দ বেশি দিতে হবে। অর্থাৎ, বাজেটে এলাকাভিত্তিক কৃষি বরাদ্দ দেওয়াটা জরুরী ছিল।
বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী এবং খানি সভাপতি ড. মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘নগদ বরাদ্দ বা অন্য যে কোন উপায়ে গ্রামীণ কৃষির ভগ্নদশা ঘুচাতে হবে। সবটাইক কৃষককে ঋণ করে নিতে হয় কেন? ৮৫% খাদ্য যারা উৎপাদন করছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ঋণের দায়ে তারা যেন আবদ্ধ হয়ে না থাকে। এই বাজেটে মূল উপকারভোগীরা হলো বড় কৃষক। সবার জন্য সাম্যাবস্থা তৈরি করতে অভ্যন্তরীণ গবেষণা, কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ইনোভেশন এবং কমার্শিয়ালাইজেশন প্রয়োজন। বিপণন ব্যবস্থা ঠিক করতে ভোক্তা ও উৎপাদকদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন গঠন জরুরী।
এছাড়াও খানি আয়োজিত এই প্রাক বাজেট প্রতিক্রিয়া বিষয়ক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শষ্যবীমা, পণ্যভিত্তিক উৎপাদন এলাকায় ওয়্যার হাউজ ও হিমাগার, কৃষি পরিবহনের জন্য আলাদা পরিবহণ ব্যবস্থা, ট্রেনে ফ্রিজিং কম্পার্টমেন্ট যুক্ত করা, জৈব সারের নিবন্ধন সহজ করা, নতুন দরিদ্র কৃষক পরিবারের জন্য খাদ্য সহায়তা, ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের অনুদান প্রদান, নগর কৃষি, দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সহায়তা করা, পারিবারিক কৃষির উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ, জৈব ও জৈব বালাইনাশকের ওপর ভর্তুকি প্রদান, কৃষি শ্রমিকদের পুনর্বাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে বাজেটে কোন নির্দেশনাই নেই বলে উল্লেখ করা হয়।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) এই ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খানি সদস্য সংগঠনের প্রতিনিধিগণ, সাংবাদিক, উন্নয়ন কর্মী, কৃষি সংগঠক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।