রংপুর বিভাগ মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পে জলাশয় সংস্কারে সুফলভোগীদের নাম ভাঙ্গিয়ে চিহ্নিত মহল কোটি কোটি টাকা সুফল ভোগ করছে। প্রকল্প অনুমোদনের আগেই ৩০ শতাংশ টাকা ব্যয় হওয়ায় বরাদ্দ্কৃত অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ নয়ছয় হয়। ফলে প্রকল্পটির মুল উদ্দেশ্যে ভেস্তে যেতে বসেছে। ওই প্রকল্পে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে দিনাজপুরে মৎস্য কর্মকর্তা, প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার গ্রেফতার হয়। এবারো জুনের মধ্যে প্রকল্পটিতে ১২ কোটি টাকা নামমাত্র কাজ দেখিয়ে জায়েজের চেষ্টা চলছে।
প্রকল্পটির রংপুর বিভাগ কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ৬ বছর মেয়াদে বিভাগের ৮ জেলার ৫৮ উপজেলায় সরকারী, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিলুপ্ত ছিটমহলের জলাশয় পুনঃ খনন, সংস্কারে ৮৭ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহন করা হয়। চলতি অর্থবছরে গাইবান্ধায় সোয়া ৪ কোটি টাকায় ২৫ টি প্রকল্প, কুড়িগ্রামে ৩ কোটি টাকায় ২৮ টি, রংপুরে ৩ কোটি টাকায় ২০ টি, লালমনিরহাটে সোয়া ১ কোটি টাকায় ১০টি, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁয়ে ৭৯ লাখ টাকায় ৫টি প্রকল্পসহ মোট ৮৯টি প্রকল্পে ১২ কোটি টাকার কাজ চলছে। জলাশয়গুলোর আশপাশে থাকা মৎস্যজীবিদের (জেলে) নিয়ে গঠিত সুফলভোগী কমিটি জলাশয় পুনঃ খনন-সংস্কারের কথা। কিন্তু তাদের দু’একজনকে নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিহ্নিত মহলটি শুরু থেকেই মনগড়া সুফলভোগী কমিটি দিয়ে কাজ করছে।
মহলটির সাথে সম্পৃক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানায়, প্রকল্প নিতেই অগ্রিম ৩০ শতাংশ টাকা ব্যয় হয়। ফলে অগ্রিম দেয়া টাকা পুষিয়ে নিতেই প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। ফলে কোটি কোটি টাকা নয়-ছয় হয়। এমনকি একই পুকুর একাধিকবারও সংস্কার হয়েছে। গৃহীত প্রকল্প এলাকার বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঘুরে-ফিরে একই লোকজন অবহেলিত মৎস্যজীবীদের চোখে ধুলো দিয়ে কাজ করছে। ইতিপূর্বের কাজগুলো তদন্ত হলে অনিয়মের বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পীরগঞ্জে ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩টি জলাশয় ললিতাহার বিল পুকুর, পালানু শাহাপুর গুচ্ছগ্রাম পুকুর ও রওশনপুর খাসপুকুর সংস্কারে জাহাঙ্গীর আলম, পার্শ্ববর্তী গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে সাড়ে ৫৬ লাখ টাকায় আলশিয়ার বিলে একই পুকুরে দুটি প্রকল্প (অংশ-১ ও অংশ-২) দেখিয়ে সাঘাটা উপজেলার বিজয় চন্দ্র এবং গোবিন্দগঞ্জের ফয়জুর রহমান ১ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে বড়মরা, গোয়ালিনি, নোয়ার, মরাবত্তা, বস্তাহার ও দুধ পুকুর পুনঃ খনন করছে।
কাগজ-কলমে সুফলভোগীদের নাম ভাঙ্গিয়ে উল্লেখিত ব্যক্তিরা কাজগুলো করছে। আলশিয়ার বিলের শুধু পশ্চিম এবং উত্তর পাড় মাটি দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। ফলে বৃষ্টি হলেই দক্ষিণ ও পুর্ব পাড় ভেঙ্গে যাবে বলে এলাকাবাসী জানায়। সাঘাটার বিজয় জানান, আলশিয়ার বিল সংস্কারে আমি সুফলভোগী অনীল ও ধীরেনকে সহায়তা করেছি। আলশিয়ার বিলের সুফলভোগী অনীল ও ধীরেন জানায়, আমরা কাগজে স্কাক্ষর দিয়েছি। কাজ করেছে বিজয় দাদা।
বিলটির এলাকার হরিনাথপুর দক্ষিণপাড়ার ওয়ালিয়ুর রহমান, নাজিম উদ্দিন ও বাবলু জানায়, বিজয় নামে এক কন্টাক্টর (ঠিকাদার) আলশিয়া বিল খনন করে। বিলটিতে একটি পুকুর সংস্কার হলেও দুটি পুকুর দেখানো হয়েছে। কাজটিতেও শুভংকরের ফাঁকি দেয়া হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জের ফয়জুর রহমান বলেন, আমি একটি পুকুর পুনঃ খনন করছি। গাইবান্ধা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দাইয়ুন বলেন, সুফলভোগীরা হয়তো কারো সহায়তা নিয়ে জলাশয় সংস্কার করেছে। তবে সুফলভোগীই কাজের চেক গ্রহন করে। রংপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রী বরুণ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আমার প্রয়োজন কত পরিমান মাটি কাটা হয়েছে। যদি সুফলভোগী কাজ না করে অন্যের সহায়তা নেয়। সেক্ষেত্রে আমার কিছুই করার নেই।
প্রকল্পটির পিডি আতাউর রহমান ৩০ শতাংশ টাকা অগ্রিম নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, আমি শুধু বরাদ্দ ছাড় ও মনিটরিং করি। জেলা-উপজেলা কর্মকর্তারাই সব করেন। একই ব্যক্তি বরাবরই কাজ করেন। এমন অভিযোগ যদি প্রতিবেদনে আসে তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটিতে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর দুদক দিনাজপুর জেলা মৎস্য অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী মঞ্জুরুল ইসলাম ও ঠিকাদার আফসার আলীকে ১৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এবং গত বছরের ৯ জুলাই জেলাটির পার্বতীপুর উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে ২০ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করে।