দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে খাঁনপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামে রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি। দূর- দরান্ত থেকে এটি দেখতে আসেন পর্যটকরা। অনেকে ভবনের ভেতরে-বাইরে ছবি তোলেন। সংস্কার করলে এই বাড়িকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
দীর্ঘদিন ধরে অযতœ-অবহেলায় ধ্বংস হতে বসেছে জমিদার বাড়িটি। ইতোমধ্যে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে এর অবকাঠামো। সংস্কারের মাধ্যমে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে বাড়িটি হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। তাঁদের আশা, তখন দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়বে।
পাশর্^বর্তী ফুলবাড়ি উপজেলার চাঁনপাড়া থেকে জমিদার বাড়িটি দেখতে এসেছেন আমিনুল ইসলাম ও মানিক মিয়া তাঁরা বলেন, ‘জমিদার বাড়িটি প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক নিদর্শনের প্রতীক। এখানে এসে আমরা মুগ্ধ। সংশ্লিষ্টদের উচিত এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা। বাড়িটির সংস্কার হলে আরও সুন্দর লাগবে। তখন দর্শনার্থীদের সমাগম বাড়তে পারে।
বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিমল কুমার সরকার জানান, প্রাচীন জমিদার বাড়িটির বয়স প্রা ২০০ বছর। তিনি স্বীকার করেছেন, সংস্কারের অভাবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এটি। তাঁর আশ্বাস, ‘বাড়িটি সংস্কার করে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে কিছুদিনের মধ্যে প্রতœত্ত অধিদফতর ও জেলা পরিষদের কাছে চিঠি লিখবো।
আশা করি, এটি সংস্কারের পর জেলা পরিষদ ডাকবাংলো হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। প্রতœত্ত্ব অধিদফতর পদক্ষেপ নিলে বাড়িটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ফলে বিরামপুরের এই অংশে পর্যটক সমাগম বাড়বে।
জমিদার বাড়িটির ইতিহাসঃ
ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থান। উপজেলার ৩নং খানপুর ইউনিয়নের রতনপুর বাজারের উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত এই প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনস্বরূপ জমিদার বংশের বাড়িটি যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিরামপুরসহ আশেপাশে অঞ্চলগুলোতে প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করার জন্য অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশরা ফুলবাড়ি জমিদারের পক্ষে রাজকুমার সরকারকে রতনপুর কাচারিতে প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজকুমারের মেধা চতুরতা আর কৌশলতায় তার ভাগ্যের চাকা বদলে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
অবাক ব্যাপার যে, রাজকুমারের খাজনা আদায়ে পারদর্শীতায় ও নৈপুণ্যে জমিদার সাড়ে ছয়’শ বিঘা জমি উপহারসহ তার নিজের বোনের সাথে রাজকুমারের বিয়ে দেন। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের মত সৌভাগ্যক্রমে সাধারন খাজনা আদায়কারী থেকে জমিদার বনে যান।
আরো জানা যায়, রাজকুমার অধিক অর্থসম্পদের লিপ্সায় মেতে উঠে স্থানীয় রঘু হাসদা নামের এক অঢেল সম্পত্তির প্রতাপশালী সাঁওতালের কাছ থেকে ধার করে নেয়ার কথা বলে ৫ বস্তা কাঁচা টাকা দিয়ে অন্য জমিদারগণের নিকট ৩’শ বিঘা জমি কিনে নেন । এ ঘটনার ২বছর পর আবারো রঘু হাসদার আড়াইশো বিঘার ফলের বাগান চতুরতায় কয়েদ করে নিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে উপকারী রঘু হাসদাকে এলাকা থেকে বিতাড়িত করেন।
মোট ১২শ বিঘার ফলদ, বনজ ঔষধি জমির মালিক ধূর্ত রাজকুমার নামের নব্য জমিদার আরাম আয়েশের জন্য বিলাসবহুল অভিজাত চমকপ্রদ এই সুদৃশ্য দ্বিতল অট্রালিকা নির্মাণ করেন। কিন্তু তার এ সুখ বেশী দিন স্থায়ী হয়নি, জমিদারের দুইপুত্র রতন কুমার ও রখুনী কান্ত বাবুর মধ্যে বড় ছেলে রতন কুমার ১৬ বছর বয়সে মন্দিরের পুষ্করিনীতে স্নান করতে গিয়ে ডুবে মরে।
এতে পুত্রের অনাকাংখিত বিয়োগান্তে জমিদার শোকে বিহব্বল আচ্ছন্নের মত নির্বিকার হন যা পরবর্তীতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে নিজের জীবন প্রদীপও নিভে যায়। পুত্র শোকে কাতরতায়-অবসাদ-বিশাদগ্রস্থতায় আর হতাশায় জমিদার মারা যান।
রতনপুর জমিদার বাড়ির পরবর্তী অধ্যায়ে উত্তরাধীকারী হিসেবে পিতার মৃত্যুর পর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রমার্ধে একমাত্র পূত্র রখুনী কান্ত বাবুই পৈত্রিক সূত্রে জমিদারী লাভ করেন ও মালিক হন এই জমিদার বাড়িটির।
যতদূর জানা যায়, রখুনী কান্ত বাবু জমিদারী থাকাকালীন সময়ে তার বাড়িতে ১০০টি বিড়াল পুশেছিলেন, যে বিড়ালগুলোর দুধের বাটি দিলেও দুধ পান করত না যতক্ষন পর্যন্ত মনিবের হুকুম না হত। জমিদার রখুনী কান্তর দরবারে প্রতিবেশী কেউ গেলে প্রস্থানের পর উক্ত স্থান ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নেয়া হত। আরো জানো যায়, জমিদার রখুনী কান্ত বাবুর কোন সন্তান ছিলনা।
কিন্তু, ১৯৭১ সালে এদেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলে রখুনী কান্ত বাবু স্বস্ত্রীক নিয়ে একটি মহিষের গাড়িতে চড়ে রাতের আঁধারে কলকাতার উদ্দ্যেশে তাঁর বংশধরদের কাছে পাড়ি দেন।
জমিদার বাড়িটিতে ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার হলেও ঝূঁকিপূর্ণ হওয়ায় উত্তর পাশে আর একটি নতুন ভবন তৈরি করা হয়েছে যেটি খাঁনপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে রখুনী কান্ত বাবুর জমিদার বাড়ির পাশে রয়েছে ইসলামিক মিশন, মাদ্রাসা, মসজিদ, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানসহ বিশাল একটি পুকুর।
বর্তমানে রখুনী কান্ত বাবুর ১২’শ বিঘা জমি ফলদ, বনজ ও ঔষুধি বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে অনেক সম্পত্তি বিলীন ও বেদখল হয়ে গেছে, যতটুকুর হদিস মিলেছে ততটুকুই দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মহোদয় জমিদার রখুনী কান্ত বাবুর সম্পত্তি ১নং খাস খতিয়ানে অন্তর্ভূক্তি করেছেন। লতায় পাতায় ছেঁয়ে যাওয়া জীর্ণ জংগলময় ভূতুড়ে পরিত্যক্ত এই জমিদার বাড়িটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার্থে সংস্কারের জন্য দিনাজপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষে এর আগে উদ্যোগ গ্রহন করা হয়।
বাড়িটি সম্পর্কে খানপুর ইউপি চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী মন্ডল বলেন, কয়েক বছর আগে শামীম আল রাজী জেলা প্রসাশক (প্রাক্তন) এর পক্ষ থেকে সাবেক ইউএনও এসএম মনিরুজ্জামান আল মাসউদ এর মাধ্যমে রক্ষুনি কান্তর জমিদার বাড়িটির সংস্কারের জন্য গম বরাদ্দ এসেছিল এবং সংস্কার করা হয়। কিন্তু, বর্তমানে আগের মতই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
দিন দিন ভবনটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটি পুনরায় সংস্কার করলে সরকারি কার্যক্রমে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেটি আমাদের বিরামপুর উপজেলায় জমিদার বাড়ির স্মৃতি হিসেবে যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।