মুষ্টিমেয় মানুষের ভোগ-বিলাসিতা এবং স্বাচ্ছ্বন্দের জন্য আরও গভীর হচ্ছে জলবায়ু সংকট। যার মাসুল দিতে হচ্ছে অগুণতি দরিদ্র মানুষকে। কোভিড-১৯-এর মত নতুন নতুন স্বাস্থ্য ঝুঁকি, অভিবাসন, খাদ্য ও পানি সরবরাহ, জীবন-জীবিকার সংকট ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন সব কিছুই জলবায়ু পরিবর্তনের ফল।
জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা যতোই বাড়বে, সামগ্রিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি হয়ে পড়বে আরো কঠিন। তাই আসন্ন জাতিসংঘ জলবায়ু বিষয়ক কপ২৬ সম্মেলনে মানবাধিকার সুরক্ষা ও জলবায়ুজনিত ক্ষয়-ক্ষতি (লস এন্ড ড্যামেজ) মোকাবিলায় অর্থায়নের দাবি তুলবে বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক জলবায়ু অবরোধ কর্মসূচির আওতায় তরুণ জলবায়ু কর্মীদের সাথে এক ডিজিটাল সংলাপে এমনই তথ্য জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দা মুনা তাসনীম।
গতকাল শুক্রবার (১৯ই মার্চ) রাতে প্রতীকি যুব সংসদ, কোস্টাল ইয়ুথ অ্যাকশন হাব ও ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের যৌথ আয়োজনে এক সংলাপের গেস্ট অব অনার হিসেবে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত কপ২৬ সম্মেলনের বাংলাদেশের প্রস্তুতি সর্ম্পকে বলতে গিয়ে জলবায়ু সহনশীল কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করেন।
এছাড়া যুবদের ফ্রাইডেস ফর ফিউচার আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে তিনি জলবায়ু সুবিচার আদায়ে বাংলাদেশের তরুণদের সচেতনতামূলক কর্মকান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।
বাংলাদেশে আমাদের জতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত, গ্রেটা থুনবার্গের মত হাজার হাজার নেতা দরকার বলে উল্লেখ করেন হাইকমিশনার। অনুষ্ঠানটি আয়োজনে সহযোগিতা করে ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রকাশ কর্মসূচি।
লন্ডনে নবগঠিত সিভিএফ হাইকমিশনার/অ্যাম্বাসেডরস ফোরামের কথা উল্লেখ করে হাইকমিশনার জানান সিভিএফ প্রেসিডেন্সি হিসাবে বাংলাদেশ সিভিএফ সদস্য দেশগুলোর ১.২ মিলিয়ন অসহায় মানুষের জন্য অরো স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে কপ২৬ প্রেসিডেন্সি হিসেবে যুক্তরাজ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।
কমনওয়েলথ ও জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্থ ফোরামের (সিভিএফ) মাধ্যমে বৃহত্তর সহযোগিতা ও সংযোগ তৈরির প্রত্যাশা তিনি ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, কপ২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশ লস এন্ড ড্যামেজকে কেন্দ্র করে শক্ত অবস্থান নেবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে জাতিসংঘে একজন বিশেষ র্যাপুটিয়ার নিয়োগের দাবি জানাবে।
এর পাশাপাশি জাতিসংঘকে জলবায়ু সহশীলতা ও সুবিচার দিবস ঘোষণা করতে হবে। এছাড়া জলবায়ু প্রশমনে গুরুত্ব পাবে প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টিও। বাংলাদেশের ৮৫ ভাগ তরুণ জলবায়ু সর্ম্পকে জানে উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন, তরুণদের জলবায়ু আন্দোলন যৌক্তিক কারণ আগামীর পৃথীবিতে তাদের বসবাস করতে হবে।
পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদের সভাপতিত্বে সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের আহবায়ক নাহিম রাজ্জাক এম.পি। অনুষ্ঠানে জলবায়ু কার্যক্রম ও অর্থায়নের যথাযথ ব্যাবহার নিশ্চিত করতে তরুণদের অংশগ্রহণ বিষয়ে মূল তথ্যপত্র উপস্থাপন করেন প্রতীকি যুব সংসদের নির্বাহী প্রধান সোহানুর রহমান।
ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের প্রধান সমন্বয়ক শাকিলা ইসলামের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এসএম মুনজুরুল হান্নান খান, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব:) ফোরকান আহমদ, বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার, ফেনীর জেলা প্রশাসক মো: ওয়াহিদুজ্জামান, ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রকাশ কর্মসূচির ম্যানেজার আবুল বাশার প্রমুখ।
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দা মুনা তাসনীম বলেন, কার্বন নিঃসরণে দায় নগণ্য হলেও বাংলাদেশ এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম রয়ে গেছে। জলবায়ু অভিযোজনের সীমাবদ্ধতা আছে।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব এবং এর জনগণের সাহস ও শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সমাজভিত্তিক দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও অভিযোজন উভয় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
ভাসমান বীজতলা, লবন সহনশীল ধানের জাত বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে জলবায়ু আন্দোলনের সামনে থেকে আওয়াজ তুলতে হবে কারন আগামীর পৃথিবীতে তাদেরকেই বসবাস করতে হবে।
তরুণদের প্রশ্ন তুলতে হবে, আমাদের সাথে কেন অবিচার করা হবে? বিশ্ব সম্প্রদায়ের গাফিলতির কারনে আমরা কেন জীবন-জীবিকা হারাবো? জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মতো হুমকির মুখে থাকা দেশগুলোসহ এ ধরণীকে বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় এখনই সবাইকে বিশেষ নাগরিক সমাজ, যুব সম্প্রদায়, নারী, প্রতিবন্ধীদের সাথে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা খুবই ঝুকিপুর্ণ উল্লেখ করে কোস্টাল ইয়ুথ অ্যাকশান হাব উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান।
সৈয়দা মুনা তাসনীম বলেন, ‘ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ সুরক্ষায় শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। বাংলাদেশ সংসদ জলবায়ু পরিবর্তনকে গ্রহজনিত জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে।
জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তুলতে কারও সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে প্রধানমন্ত্রী প্রথম এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত, ২৭টি মন্ত্রনালয়ে ২৯ হাজার টাকা জলবায়ু বাজেট প্রদান ও ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০ প্রণয়ন করেন এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ করে, ‘মুজিব প্ল্যানেটারি সমৃদ্ধির দশক (২০২০-৩০) এবং অ্যাকশন প্ল্যান ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ কারো কাছে হাত পেতে নয়, মাথা উঁচু করে বাঁচবে। যুব সমাজ মাথা উঁচু করে চলবে।
সংলাপের প্রধান অতিথি ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের আহবায়ক নাহিম রাজ্জাক এমপি বলেন, উন্নয়নক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগুলো জলবায়ু সুরক্ষার বিষয়ে বেশিদূর আগাতে সক্ষম হয়নি। নীতি ও আইন থাকার পরও অনেক কিছুই তৃণমূলে বাস্তবায়ন হচ্ছে না যা আসলেই দু:খ জনক। প্রত্যেকটির সমস্যারই সমাধান রয়েছে।
সমাধানগুলো সমন্বিত হতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদেরএক্টিভিজম খুবই গুরুত্বপুর্ন। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য দরকার মানুষের আচরণগত পরিবর্তন ও আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। জলবায়ু সুরক্ষার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারি। বিদ্যুত অপচয়, প্লাস্টিক হ্রাস করার পাশাপাশি সবুজ ব্যাবসায়িক উদ্যোক্তা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী খাতকে প্রণোদনা দিতে হবে।
যৌথ মনিটরিং ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তরুণরা গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তার নির্বাচনী এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষ বাস্তচ্যুত হচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন। তাদের পুর্নবাসনে গুচ্ছগ্রাম উদ্যোগ সরকার বাস্তবায়ন করছে।
আসন্ন জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ২৬ ও যুব সম্মেলনে তরুণদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে লন্ডস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের দৃষ্টি আর্কষণ করেন। সংলাপে কোস্টাল ইয়ুথ অ্যাকশন হাবকে শক্তিশালী করতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় একটি যুব নেতৃত্বে প্রকল্পের উদ্ধোধন করে ক্লাইমেট পার্লামেন্টের মাধ্যমে নীতি অধিপরামর্শ পরিচালনায় যৌথ কার্যক্রমের অঙ্গীকার করেন।
সবুজ জলবায়ু তহবিলের প্রক্রিয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ বলেন, এ তহবিলটা যেন গঠনই করা হয়েছে টাকা না দেয়ার জন্য। সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে অনেক অর্থ পাওয়ার কথা থাকলে বাংলাধেম অনুদান হিসেবে পেয়েছে মাত্র ১শ মিলিয়ন ডলার ও আড়াইশ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে ঋণ হিসেবে। কিন্তু জলবাযু অর্থায়নে ঋণের কোন কথা ছিলনা।
বলা হয়েছিল এটা উন্নয়ন তহবিলের বাইরে নতুন অনুদান সরকারীভাবে সরকারকে দেয়া হবে। কিন্তু এগুলো কোন কিছুই মানা হচ্ছে না। ভালো ভালো প্রকল্প জমা দিলেও তারা বেহুদা প্রশ্ন তোলে, দীর্ঘসূত্রিতা কনসালটেন্ট নিয়োগ করে প্রক্রিয়াটাকে জটিল করে সমস্যা সৃষ্টি করে। অঙ্গীকার করেও তারা কথা রাখেনা। তাদের তহবিলে অর্থও নাই।
আমরা নিজেরা যা খরচ করি তার ১০ শতাংশও খরচ হয়না। তাই আন্তজার্তিক আন্দোলনে আমাদের সুর মেলানোর পাশাপাশি নিজেদের প্রস্তুত হতে হবে। জলবায়ু প্রকল্পগুলো স্থানীয় বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা আনতে তরুণরা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারে।
ক্ষয়-ক্ষতি বা লস এন্ড ড্যামেজ মোকাবিলায় অভিযোজন তহবিলে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তুদের কানকুন ফ্রেমওর্য়াক অনুযায়ী পুর্নবাসনের আহবান জানান।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এসএম মুনজুরুল হান্নান খান বলেন, কপ২৬ এ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে অভিযোজন ও প্রশমনে যুব সম্প্রদায়ের দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সবুজ জলবায়ু তহবিলে তরুণদের কার্যক্রমে বিনিয়োগ করতে স্পষ্ট নির্দেশনা অনুমোদন করতে কপ সম্মেলন ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন।