ঘেরের পাড়ে সারি সারি গাছে সুতোর মাচায় ঝুলছে লাল টকটকে টমেটো।দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এত সুন্দর এবং পুষ্টিগুন সম্পন্ন দামি এই সবজি-ই বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কৃষকদের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। স্থানীয় বাজারে মাত্র ১ থেকে ২ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে এই টমেটো।ঘেরের পাড় ও ক্ষেত থেকে টমেটো তোলার শ্রমিক খরচ-ই উঠছে না। যার ফলে ক্ষেত থেকে কেউ টমেটো তুলছেন না।
চাষীর ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে কয়েকশ টন পাকা টমেটো। পাকা টমেটো বিক্রি করতে না পাড়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে দাবি করেছেন কৃষকরা। তবে কৃষি বিভাগ বলছে চিতলমারীর চাষীরা প্রথম দিকে ভাল দামে টমেটো বিক্রি করে লাভবান হয়েছে। বাগেরহাট জেলায় ১ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি চাষ হয়েছে চিতলমারী উপজেলায়। এই উপজেলায় ৬১৫ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। যেখান থেকে প্রায় ২৭ হাজার ৬৪৫ টন টমেটো উৎপাদন হয়েছে।
হাইটম ও মিন্টুসুপার জাতের হাইব্রিড টমেটো চাষ করেন তারা। যার ফলে শীত আসার আগেই টমেটো বিক্রি করতে পারেন তারা। প্রথম দিকে ৮০ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করেছেন তারা।ধীরে ধীরে ফলন বৃদ্ধির সাথে সাথে কমতে থাকে টমেটোর দাম। তিন-চার মাসে ৮০ টাকার টমেটো এসে দাড়িয়েছে ১ থেকে ২ টাকায়। যার ফলে ক্ষেতেই নষ্ট করে ফেলছেন ঘামে ঝড়ানো এই ফসল।
কেউ কেউ আবার এই টমেটো তুলে গরুসহ বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণিকে খাওয়াচ্ছেন।পাকা টমেটো পড়ে ঘেরের পানি নষ্ট হয়ে মাছ মারা যাওয়ার শঙ্কায় বাধ্য হয়ে শ্রমিক নিয়ে ঘেরের পাড় থেকে গাছসহ টমেটো তুলে ফেলে দিচ্ছেন পরিত্যক্ত স্থানে। সময়মত টমেটো তুলে বিক্রি না করার ফলে শুধু চিতলমারি উপজেলাতেই ৩শতাধিক টন টমেটে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রথম দিকে চড়া দামে বিক্রি করলেও ভরমৌসুমে দাম কম থাকায় টমেটো চাষে লোকস্না হচ্ছে। এই অবস্থায় সরকারের কাছে টমেটো সংরক্ষনাগার তৈরির দাবি জানিয়েছেন চাষীরা। চিতলমারী উপজেলার গরীবপুর গ্রামের কতিপয় চাষীরা বলেন, আমরা এই অঞ্চলের মানুষ সারা বছরই কোন না কোন ফসল রোপন ও পরিচর্যা করে থাকি। এই ফসল থেকেই আমাদের ভাত-কাপড় হয়।
টমেটো বিক্রি করে প্রতিবছরই আমরা একটা ভাল আয় করে থাকি। এবছর মৌসুমের শুরুতে ৮০ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করেছি।তবে তখন ক্ষেতে পর্যাপ্ত টমেটো ছিল না। ধীরে ধীরে ফলন বৃদ্ধির সাথে সাথে দামও কমতে শুরু করেছে।৮০ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। কেজি যখন ১ থেকে ২ টাকায় নেমে এসেছে তখন টমেটো তোলা বন্ধ করে দিয়েছি।এই দামে আমাদের টমেটো তোলা ও পরিবহন খরচ ওঠে না। যখন দাম থাকে তখন আমাদের টমেটো থাকে না। আর যখন টমেটো বেশি থাকে তখন দাম থাকে না।
বর্তমানে টমেটোর কেজি এক টাকা হলেও, মাত্র এক মাস পরে এই টমেটো ৫০ টাকা বিক্রি হবে। কিন্তু তখন আমাদের ক্ষেতে কোন টমেটো থাকবে না। যদি সরকারিভাবে এই টমেটো সংরক্ষন করার সুযোগ করে দিত তাহলে আমরা খুব উপকৃত হতাম। চরবানিয়ারি গ্রামের চাষী সুধাংশু বালা বলেন, ঘেরের পাড়ে প্রায় ৪ হাজার টমেটো গাছ লগিয়েছিলাম। মাত্র এক লক্ষ ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। এখানে আমার প্রায় তিন লক্ষাধিক টাকা বিক্রি করার কথা ছিল।
এখনও ক্ষেতে যে পরিমান টমেটো রয়েছে যদি ২০ টাকাও দাম থাকতো তাহলে মোটামুটি ভাল লাভ হত। আশিষ দে, ঝর্ণা মন্ডল, তপন কুমারসহ কয়েকজন চাষী বলেন, অনেক কষ্ট করে টমেটো গাছ রোপন করি। একটি টমেটো গাছের জন্য আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। কিন্তু ঠিকমত দাম পাই না আমরা। আমাদের এখানে এখন এক টাকা দাম হলেও বাগেরহাট শহরে এই টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরে। এর বাইরে খুলণা, ঢাকাতেও শুনি আরও বেশি দাম।
তবে আমরা উৎপাদন করে কি পাপ করেছি চিতলমারী উপজেলার কুরমনি গ্রামের কৃষক বলেন, ৪ বিঘা জমির মৎস্য ঘেরের পাড়ে ২ হাজার ৫‘শ গাছ রোপন করেছিলমা। এতে আমার অর্ধ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। আমি ৭০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। শেষ দিকে ভাল দামে বিক্রি করতে পারলে আরও এক লক্ষ টাকা আয় হত আমার। ৭০ হাজার টাকায় আসলে পেটে ভাতে কাজ করার মত হয়েছে।
একই গ্রামের অচ্চুদ বসু বলেন, ৪০-৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে ২হাজার গাছ লাগিয়ে ছিলাম ৫ বিঘার ঘেরে। মাত্র এক লক্ষ টাকা বিক্রি করেছি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যদি মাত্র ২০ টাকা কেজি দরে আমার টমেটো বিক্রি করতে পারতাম অন্তত দুই লক্ষ টাকা আয় হত।যে এক লক্ষ টাকা বিক্রি করেছি রোপন ও পরিচর্যার ব্যয় ছাড়া ক্ষেত থেকে তোলা ও পরিবহনের জন্য আরও ১০ হাজার টাকা আমার খরচ হয়েছে।
আসলে আমাদের মত দরিদ্র চাষীদেরই যত জ্বালা। চিতলমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বলেন, এবার টমেটোর বাম্পার ফল হয়েছে। শুরুর দিকে ৮০ টাকা দরে কেজি বিক্রি হয়েছে। এর ফলে কৃষকরা টমেটো চাষে আর্থিক দিক দিয়ে একটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছেন। তবে বর্তমানে দুই থেকে তিন টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে টমেটো।ফলে যাদের জমি রাস্তা থেকে একটু ভিতরের দিকে তারা টমেটো তুলতে পারছে না।
কারন তুলতে যে ব্যয় হয়, এই দামে বিক্রয় করলে সেই খরচও উঠে না। কয়েকশ টন টমেটো ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিগত কয়েকবছর ধরে চেষ্টা করছি টমেটো সংরংক্ষণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করার। যদি এখানে হিমাগার করা যায় তবে স্থানীয় কৃষকরা লাভবান হবে।যদি স্থানীয় উদ্যোক্তা বা সংরক্ষনাগার থাকলে কৃষকদের বিপাকে পড়তে হবে না।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য) আব্দুল¬াহ আল-মামুন বলেণ, বাগেরহাটে এবছর আমাদের ৪৫ হাজার মেট্রিকটন টমেটো উৎপাদন লক্ষমাত্রা ছিল।কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ও সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে এবছরে আমাদের লক্ষমাত্রা পূরন হয়েছে। গেল বছর ১ হাজার ৬‘শ হেক্টর জমিতে আমাদের টমেটো উৎপাদন হয়েছিল ৪০ হাজার মেট্রিক টন।দিনদিন আমাদের জেলায় টমেটো চাষের জমি ও চাষী বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা চাষীরা যাতে উপযুক্ত দাম পায় সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।