ফটিকছড়িতে গৃহবধূ হাসনা বেগম মুন্নী’র মৃত্যুর ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত মৃত্যু রহস্যের জট খুলেনি। পাশাপাশি তার এ রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাত ১১ টার দিকে উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভাধীন ৭ নং ওয়ার্ডের মৌলানা সোলায়মান বাড়ীর ওমান প্রবাসী ফারুকের স্ত্রী হাসনা বেগম মুন্নীর রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটে।
জানা যায়, ঐদিন রাতে এক সন্তানের জননী মুন্নীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে মুখে বিষযুক্ত অবস্থায় প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। পথিমধ্যে তার মৃত্যু হলে রাত তিনটার দিকে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরে খবর পেয়ে ফটিকছড়ি থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।
তবে সূত্রে জানা গেছে, ওইদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক মুন্নীকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও শ্বশুর বাড়ীর লোকজন তা না করে নগরীর একটি বেসরকারী ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে তার মৃত্যু হলে পুলিশকে না জানিয়ে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এক পর্যায়ে রাতের আঁধারে লাশ দাফনের চেষ্টা করলে খবর পেয়ে পুুলিশ লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে মুন্নীর শাশুড়ী ছাবিহা আকতারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ওইদিন মুন্নীসহ ঘরের সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাত ১০টার দিকে যার যার কক্ষে শুয়ে পড়ি। ১১টার কিছুপর হঠাৎ মুন্নী এসে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সে বিষপান করেছে বলে জানায়। এরপর আমার স্বামীর কক্ষে গিয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বিষয়টা বলি। পরে আমার দেবরের ছেলে পেয়ারুর সিএনজিতে করে মুন্নীকে নাজিরহাট হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়ার পথে সম্ভবত শহরের ২নং গেইট এলাকায় মুন্নীর মৃত্যু ঘটে। পরে পেয়ারুর পরামর্শে বেসরকারি একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার মুন্নীকে মৃত ঘোষণা করলে সাথে সাথে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি।
মুন্নী কী কারণে বিষপান করতে পারে, তা জানতে চাইলে এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি শাশুড়ী ছাবিহা আকতার। তবে বউ-শাশুড়ীর মাঝে সুসম্পর্ক ছিল দাবী করে তিনি বলেন, সর্বশেষ রাতে শুয়ে পড়ার পর চোখে ঘুম আসার আগমুহুর্ত পর্যন্ত পাশের রুমে থাকা মুন্নীর মোবাইলের আলো জ্বলতে দেখেছি। সম্ভবত প্রতিদিনের মত ছেলে এবং বউ মুঠোফোনের মাধ্যমে কথা বলছিল। এরপর আমি আর কিছুই জানি না।
এদিকে, পারিবারিক কলহ নিয়ে শাশুড়ীর মানসিক নির্যাতনের কারণে মুন্নী আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তার বাপের বাড়ীর লোকজন। এ বিষয়ে তারা বলেন- ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে মুন্নীর একটি স্বর্ণের চেইন শাশুড়ি শ্বশুরকে না জানিয়ে বিক্রি করে সমুদয় টাকা মুন্নীর বিবাহিতা ননদ ইয়াছমিনকে দিয়ে দেয়।
বিষয়টি শ্বশুর মুন্নীর মাধ্যমে জানতে পেরে স্বর্ণের চেইনটি কেন বিক্রি করা হয়েছে শাশুড়ীর নিকট তার কৈফিয়ত জানাতে চায়। পরে এ নিয়ে মুন্নী ও তার শাশুড়ির মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে শাশুড়ি মুন্নীকে ৪/৫ দিন ধরে নানাভাবে চাপে রাখে। মানসিক চাপের কারণে মুন্নী আত্মহত্যা করেছে বলে দাবী করে তার স্বজনরা আরো বলেন, মুুন্নীর শ্বশুরবাড়ীতে নিশ্চই কিছু না কিছু একটা হয়েছে, তা না হলে মুন্নীর মত শান্ত স্বভাবের মেয়ে বিনা কারণে এভাবে আত্মহত্যা করতে পারে না।
এদিকে, এ ঘটনায় মুন্নীর শ্বশুর নুরুল আলম, শাশুড়ি ছাবিহা আকতার ও দেবর সিএনজি চালক পেয়ারুল ইসলামকে আসামী করে চট্টগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেছেন নিহত মুন্নীর নানা সিরাজুল হক।
অন্যদিকে, মুন্নীর মৃত্যুর পেছনের কারণ হিসেবে পারিবারিক কলহের পাশাপাশি অনুসন্ধানে উঠে আসছে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কও। জানা গেছে, তিন বছর পূর্বে ওই এলাকার নুরুল আলমের পুত্র ওমান প্রবাসী ফারুকের সঙ্গে হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের মাহামুদাবাদ গ্রামের মাহমুদুল হক মুন্সীর বাড়ীর দিদারুল আলমের মেয়ে মুন্নীর বিয়ে হয়। ছোটকালে পিতা-মাতা মারা যাওয়ার কারণে মামার বাড়িতে লালিত-পালিত হন মুন্নী। সেখান থেকেই মুন্নীকে বিয়ে দেয়া হয়।
বিয়ের ৩ মাস পর স্বামী পুনরায় ওমানে চলে যায়। স্বামীর অনুপস্থিতিতে মুন্নীকে বাপের বাড়িসহ আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে নিয়মিত আনা-নেওয়া করতেন সম্পর্কে ফারুকের চাচাতো ভাই পাশের ঘরের সিএনজি চালক পেয়ারু। সেই সুবাদে সুদর্শন পেয়ারুর সঙ্গে মুন্নীর সখ্যতা গড়ে উঠে। তাদের দু’জনের এ সম্পর্ক কিছুদিনের মধ্যে পরকীয়া প্রেমে রূপ নেয় বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এক সময় স্বামী ফারুক স্ত্রীর পরকিয়া প্রেমের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মুন্নীর ব্যবহৃত স্মার্টফোনটি তার মাকে দিয়ে দিতে বলে। এরপর থেকে স্বামীর কথামতো শাশুড়ির মোবাইলে ফারুকের সাথে যোগাযোগ করে আসছিল স্ত্রী মুন্নী। স্মার্টফোনটি নিয়ে নেওয়াকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহের সৃষ্টি হয়, যা পরে ঝগড়া ও গালিগালাজ পর্যন্ত গড়ায় বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত পেয়ারুর সঙ্গে কথা হলে তিনি গৃহবধূ মুন্নীর সঙ্গে প্রেমের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ফারুক আর আমি আপন চাচাতো ভাই। পাশাপাশি ঘর হিসেবে আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ও আসা যাওয়া আছে। সিএনজি চালক হিসেবে তাদের পরিবারের ভাড়া গুলোতে আমাকে অগ্রাধিকার দেয়, এর বাইরে অন্যকিছু নয়। তবুও কেন তাকে মামলায় আসামী করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে পেয়ারু বলেন, এ নিয়ে আমার মাথায় কিছু আসছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম বলেন, গৃহবধু মুন্নীর মৃত্যুর ময়না তদন্তের রিপোর্ট এখানো আসেনি। রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।