বর্ষিয়ান রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের এই দিনে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গিয়েছিলেন। তাকে বলা হয় যশোর উন্নয়নের কারিগর। আপাদমস্তক রাজনীতিক এই মানুষটি নানা অত্যাচার, জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করলেও কখনো পিছু হটেননি। সে কারণে তাকে যশোর তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির ‘লৌহমানব’ হিসেবেও ডাকা হতো। সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। যে কারণে তিনি ছাত্র সংসদ থেকে দেশের মন্ত্রী পরিষদে স্থান লাভ করেছিলেন। যশোরে থেকেও তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ছিলেন যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান। এছাড়া, একাধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানেও তরিকুল ইসলাম নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রয়াত এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যশোর জেলা বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে কয়েকদিন থেকে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
তরিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরে। পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন ব্যবসায়ী ও মা মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিনী। বড় ছেলে শান্তনু ইসলাম সুমিত ব্যবসায়ী। তিনি বর্তমানে পিতার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতও পিতার আদর্শ অনুসরণ করে হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর রাজনীতিক।
তিনি বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনকি সম্পাদক। স্ত্রী নার্গিস বেগম ছিলেন যশোর সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক উপাধ্যাক্ষ। যশোরের রাজনীতিতে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, তরিকুল ইসলামকে রাজনীতিক তৈরিতে স্ত্রী নার্গিস বেগমের অবদান সবথেকে বেশি। অধ্যাপক নার্গিস বেগম বর্তমানে যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মূলত ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির ময়দানে বিচরণ তরিকুল ইসলামের। তিনি ১৯৬১ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯৬৩ সালে যশোর এমএম কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৮ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি জড়িয়ে পড়েন সে সময়কার সবথেকে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে। তিনি ছিলেন বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। এই সংগঠনের প্রার্থী হিসেবে তিনি ১৯৬৩-৬৪ বর্ষে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে ‘সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠা আন্দোলন’ শুরু হলে তরিকুল ইসলাম এর যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’র নির্বাচনে তিনি অধ্যাপক শরী হোসেনের নেতৃত্বে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্যবার আটক ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তরিকুল ইসলাম। যশোর এমএম কলেজে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নিতে গিয়েও কারাবরণ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন এমএনএ আহম্মদ আলী সর্দার তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই মামলায় ১৯৬৮ সালে আটকও হন তিনি। তাকে দীর্ঘ নয় মাস যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় গণআন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে পুলিশ তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং তাঁকে আটক করে।
জাতীয় রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম ছিলেন প্রথম সারির নেতা। ১৯৭০ সালে মওলনা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করেন। ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তে দেয়া বাঁধ অপসারণে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির আহ্বানে ফারাক্কা অভিমুখী লংমার্চ সফল করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এই নেতা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরো নয় মাস অবস্থান করে দেশ থেকে যাওয়া শরণার্থী ও প্রশিক্ষণরত বীরমুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেন। পাকহানাদারদের কবল থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন তিনি।
তরিকুল ইসলাম ১৯৭৩ সালে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৭৮ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তিনি আটক হয়ে তিন মাস কারাগারে ছিলেন। মরহুম মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ন্যাপ (ভাসানী) বিলুপ্ত হলে তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির জেলা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৯ সালে যশোর-৩ (সদর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময়ে তিনি বিএনপির জেলা আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি দলের সর্বোচ্চ পদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালের ৫ মার্চ তরিকুল ইসলাম সড়ক ও রেলপথ প্রতিমন্ত্রী হন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নল দেখিয়ে হটিয়ে স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই যে সমস্ত রাজনীতিকদেরকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে রেখেছিলেন তারমধ্যে তরিকুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। প্রায় তিন মাস তাঁর উপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ হত্যা প্রচেষ্টা মামলা দায়ের করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। তিনি ছিলেন এই মামলার প্রধান আসামি। এ মামলায় দীর্ঘ নয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন তিনি। এসময়ও তরিকুল ইসলা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। জেলখানা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁকে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিবের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এসময়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় যখন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে, অনেকে কথা বলারও সাহস দেখাতে পারছিলেন না, তখন দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় ছুটে বেড়িয়েছিলেন তরিকুল ইসলাম। কখনো নিজে একা, আবার কখনো বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে তিনি দলকে সুসংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। তিনি ছিলেন দলের চেয়ারপার্সনের আস্থাভাজন একজন নেতা।
১৯৯১-এর নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলেও যশোর-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন তরিকুল ইসলাম। তবে, দলের প্রতি অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ১৯৯১ সালে সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ১৯৯২ সালে ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এসময়ে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি যশোর-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপি’র মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হলে তিনি প্রথমে খাদ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীতে তথ্যমন্ত্রী এবং সর্বশেষ বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
তরিকুল ইসলাম যশোর সরকারি সিটি কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, যশোর ইনস্টিটিউটের সহকারী সম্পাদক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগরণী চক্রে সভাপতি, কিংশুক সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্রের প্রধান উপদেষ্টা ও যশোর ক্লাবের নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
যশোর উন্নয়নে তাঁর মতো কাজ আর কোনো স্থানীয় রাজনীতিক করেছেন বলে শোনা যায় না। যশোর সদর হাসপাতালকে আধুনিক মানের জেনারেল হাসপাতাল ও পরবর্তীতে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ, যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়সহ প্রায় প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজের সাথে তরিকুল ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের খুব কাছের লোক। আজকের নেতাদের মতো কোনো ‘সাঙ্গপাঙ্গ’ নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়নি তাঁকে। যেখানেই মানুষের উপস্থিতি দেখেছেন সেখানেই বসে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। প্রতিদিন ভোরে ছুটে যেতেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। খোঁজ নিতেন নেতাকর্মীদের। এতবড় একজন নেতা হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় যে কোনো গণতান্ত্রিক ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক ও রাজপথের সৈনিক।