Dhaka ০৭:২৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একাত্তরের পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মাত্রা, নড়েচড়ে বসল ভারত

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাঁচ দশকের ব্যবধানে এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে ভিড়েছে। করাচি বন্দর থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি স্থানীয় সময় বুধবার (১৩ নভেম্বর) সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে দীর্ঘ বৈরিতা এবং দূরত্ব ঘুচিয়ে পাকিস্তানের পতাকাবাহী কার্গোটি বাংলাদেশের বন্দরে ভেড়ার বিষয়টিকে বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে। আর কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের চমকপ্রদ ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী ভারত।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এ ধরনের সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ চালু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পরার শঙ্কা দেখা গেছে।

সরাসরি এই সামুদ্রিক পথ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের উন্নয়নে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে কাজ করবে বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। তিনি বলেছেন, এই উদ্যোগটি কেবল বিদ্যমান বাণিজ্যের গতি বাড়াবে না, বরং দুই দেশের ব্যবসা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।

গত আগস্টের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানোর আশা প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালীন ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়।

দীর্ঘ সময় সম্পর্ক স্থবির থাকার পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সরকারি মহলে এই বিষয়টি নিয়ে আশাবাদ থাকলেও ভারতীয় কৌশলগত বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন যে, এই সম্পর্ক পরবর্তীতে ভারতসহ গোটা অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

মাত্র তিন মাস আগেও দুই দেশের (বাংলাদেশ-পাকিস্তান) সম্পর্ক তিক্ত ছিল। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা এ দুটি প্রধান বন্দর গত পাঁচ দশক ধরে পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ ছিল…দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সিঙ্গাপুর বা কলম্বোয় ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে করা হতো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘এখন পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রামে আসবে, ফলে অবৈধ পণ্য বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতে পৌঁছে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।’ এ সময় তিনি ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের বিশালকার চালান আটক হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করেন। এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র আটকের ঘটনা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিলের সেই অভিযানে ১০ ট্রাকভর্তি অস্ত্রগুলো পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়েরর অর্থায়নে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী উলফার কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল। প্রায় দেড় হাজার চীনা অস্ত্রের চালানটি ট্রলার যোগে চট্টগ্রামে পৌঁছায়। যার আনুমানিক মূল্য ছিল ৪ দশমিক ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন ডলার। এ চালানটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আলফার কাছে যাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ অস্ত্র পৌঁছানোর আগেই আটক করা হয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেই সময় থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সমুদ্রপথে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে এবং চীনের প্রভাব এড়াতে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। গত বছর মোংলা বন্দরের একটি টার্মিনালের পরিচালনার বিষয়ে চীনের ওপর কৌশলগত বিজয় লাভ করেছিল ভারত। কিন্তু এখন পাকিস্তান চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশাধিকার পেয়ে গেছে। এই দুই বন্দরের সমুদ্রপথ এখন পাকিস্তানি জাহাজের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। মিয়ানমারও চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকায়, এ বিষয়টি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন ভারতের নিরাপত্তা বিভাগের একটি সূত্র।

মিয়ানমার বর্তমানে একটি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে এবং ভারতে মাদক চোরাচালান ও অনুপ্রবেশের কারণে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসা কার্গো জাহাজের পণ্যের বিস্তারিত জানা না গেলেও, একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে বড় কন্টেইনারগুলো প্রথমে জাহাজ থেকে নামানো হয়। তারপর বাকি পণ্যগুলো খালাস করা হয়।

শেখ হাসিনার সঙ্গে এক সময় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রথমে কিছু ৪০ ফুটের কন্টেইনার নামানো হয় এবং সেগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এটি সাধারণত করা হয় না। ফলে, অবৈধ পণ্য প্রবেশের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ চালুর উদ্যোগকে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান প্রায় একঘরে অবস্থানে ছিল। শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৫ আগস্ট দেশজুড়ে উত্তাল আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান।

পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এর আগের ২৪ বছর পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল বর্তমান বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার শাসনামলে, বিশেষ করে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং পুনরায় টানা তিন মেয়াদে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়।

ভারতীয় এক বিশ্লেষক বলেন, ‘ড. ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করছে…এবং তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান মূলত বিভিন্ন ধরনের তুলা বাংলাদেশে রপ্তানি করে, আর বাংলাদেশ জুটপণ্য রপ্তানি করে…তবে ভারতের প্রধান রপ্তানি বাজার হিসেবে বাংলাদেশের স্থান পরিবর্তন করা অসম্ভব। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান-বাংলাদেশের এই নতুন ঘনিষ্ঠতার কারণে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এদিকে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আগামী ২০২৫ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক নৌমহড়া আমান-২০২৫-এ অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি হবে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ নৌ মহড়ায় অংশগ্রহণ…গত মাসে (অক্টোবর) একটি ফ্রিগেট পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এসব পদক্ষেপ ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। সূত্র ঃ চ্যানেল২৪

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

সুপেয় পানির অভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোলার চরাঞ্চলের নারী-শিশুরা

একাত্তরের পর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মাত্রা, নড়েচড়ে বসল ভারত

Update Time : ০৩:৫৪:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাঁচ দশকের ব্যবধানে এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে ভিড়েছে। করাচি বন্দর থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি স্থানীয় সময় বুধবার (১৩ নভেম্বর) সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে দীর্ঘ বৈরিতা এবং দূরত্ব ঘুচিয়ে পাকিস্তানের পতাকাবাহী কার্গোটি বাংলাদেশের বন্দরে ভেড়ার বিষয়টিকে বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে। আর কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের চমকপ্রদ ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী ভারত।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এ ধরনের সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ চালু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পরার শঙ্কা দেখা গেছে।

সরাসরি এই সামুদ্রিক পথ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের উন্নয়নে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে কাজ করবে বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। তিনি বলেছেন, এই উদ্যোগটি কেবল বিদ্যমান বাণিজ্যের গতি বাড়াবে না, বরং দুই দেশের ব্যবসা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।

গত আগস্টের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্রপথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানোর আশা প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালীন ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়।

দীর্ঘ সময় সম্পর্ক স্থবির থাকার পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সরকারি মহলে এই বিষয়টি নিয়ে আশাবাদ থাকলেও ভারতীয় কৌশলগত বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন যে, এই সম্পর্ক পরবর্তীতে ভারতসহ গোটা অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

মাত্র তিন মাস আগেও দুই দেশের (বাংলাদেশ-পাকিস্তান) সম্পর্ক তিক্ত ছিল। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা এ দুটি প্রধান বন্দর গত পাঁচ দশক ধরে পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ ছিল…দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সিঙ্গাপুর বা কলম্বোয় ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে করা হতো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘এখন পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রামে আসবে, ফলে অবৈধ পণ্য বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতে পৌঁছে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।’ এ সময় তিনি ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের বিশালকার চালান আটক হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করেন। এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র আটকের ঘটনা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিলের সেই অভিযানে ১০ ট্রাকভর্তি অস্ত্রগুলো পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়েরর অর্থায়নে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী উলফার কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল। প্রায় দেড় হাজার চীনা অস্ত্রের চালানটি ট্রলার যোগে চট্টগ্রামে পৌঁছায়। যার আনুমানিক মূল্য ছিল ৪ দশমিক ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন ডলার। এ চালানটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আলফার কাছে যাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ অস্ত্র পৌঁছানোর আগেই আটক করা হয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেই সময় থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সমুদ্রপথে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে এবং চীনের প্রভাব এড়াতে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। গত বছর মোংলা বন্দরের একটি টার্মিনালের পরিচালনার বিষয়ে চীনের ওপর কৌশলগত বিজয় লাভ করেছিল ভারত। কিন্তু এখন পাকিস্তান চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশাধিকার পেয়ে গেছে। এই দুই বন্দরের সমুদ্রপথ এখন পাকিস্তানি জাহাজের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। মিয়ানমারও চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকায়, এ বিষয়টি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন ভারতের নিরাপত্তা বিভাগের একটি সূত্র।

মিয়ানমার বর্তমানে একটি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে এবং ভারতে মাদক চোরাচালান ও অনুপ্রবেশের কারণে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসা কার্গো জাহাজের পণ্যের বিস্তারিত জানা না গেলেও, একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে বড় কন্টেইনারগুলো প্রথমে জাহাজ থেকে নামানো হয়। তারপর বাকি পণ্যগুলো খালাস করা হয়।

শেখ হাসিনার সঙ্গে এক সময় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রথমে কিছু ৪০ ফুটের কন্টেইনার নামানো হয় এবং সেগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এটি সাধারণত করা হয় না। ফলে, অবৈধ পণ্য প্রবেশের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ চালুর উদ্যোগকে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান প্রায় একঘরে অবস্থানে ছিল। শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৫ আগস্ট দেশজুড়ে উত্তাল আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান।

পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। এর আগের ২৪ বছর পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল বর্তমান বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার শাসনামলে, বিশেষ করে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং পুনরায় টানা তিন মেয়াদে ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়।

ভারতীয় এক বিশ্লেষক বলেন, ‘ড. ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করছে…এবং তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান মূলত বিভিন্ন ধরনের তুলা বাংলাদেশে রপ্তানি করে, আর বাংলাদেশ জুটপণ্য রপ্তানি করে…তবে ভারতের প্রধান রপ্তানি বাজার হিসেবে বাংলাদেশের স্থান পরিবর্তন করা অসম্ভব। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান-বাংলাদেশের এই নতুন ঘনিষ্ঠতার কারণে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এদিকে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আগামী ২০২৫ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক নৌমহড়া আমান-২০২৫-এ অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি হবে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ নৌ মহড়ায় অংশগ্রহণ…গত মাসে (অক্টোবর) একটি ফ্রিগেট পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এসব পদক্ষেপ ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। সূত্র ঃ চ্যানেল২৪