একটি পাঠাগার, আলো ছাড়াচ্ছে পুরো গ্রামে। পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার ফলে সেখানকার কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মোবাইলে আসক্ত না হয়ে ঝুঁকছে বই পড়ার নেশায়। ওই গ্রামের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐহিত্যসহ অন্যান্য বই পড়ে যেমনি জ্ঞান অর্জন করতে পারছে, ঠিক তেমনি জানতে পারছে বিশ্বের কোথায়-কি হচ্ছে বা ঘটনা ঘটছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মধ্যম বয়সি লোকজনও ভিড় করছেন ওই পাঠাগারটিতে। তারাও বনে গেছেন নিয়মিন পাঠকে। বলছিলাম ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের নাছির মাঝি মেঘনা নদীর কোলঘেষা প্রত্যন্ত গ্রামের শাপলা বাজারের একটি পাঠাগারের কথা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের নাছির মাঝি মেঘনা নদীর কোলঘেষা একটি বাজার, তার নাম শাপলা বাজার। নদী তীরবর্তী হওয়ায় এখানকার বেশিরভাগ মানুষই নদীতে মাছ শিকারের কাজে নিয়োজিত থাকে। এ এলাকার মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো তেমন একটা নেই বললেই চলে। তবে বর্তমান জেনারেশনের অনেকে বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষার দিকে ধাবিত করছেন। বাপ-দাদাদের পুরনো মাছ শিকার, কৃষি কাজ কিংবা অন্যান্য কাজকর্মের দিকে নিজেদের ছেলে-মেয়েদের ঠেলে দিচ্ছে না। পাঠাচ্ছেন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায়। তাদের ছেলে-মেয়েরা এখন কিছুটা হলেও শিক্ষিত হচ্ছেন। শিক্ষার হারে পিছিয়ে থাকলেও গত কয়েক বছরে গ্রামটি বেশ উন্নত হয়েছে। শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সমান তালে এগুচ্ছে গ্রামের লোকজন।
এদিকে বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আগের মত পাঠাগার কিংবা লাইব্রেরীর দিকে তেমন একটা ধাবিত হয় না। বিশ্ব যেহেতু ক্রমবর্ধমান, তাই আগামীর বিশ্ব প্রতিযোগিতা নিজ গ্রামের শিক্ষার্থীদেরকে সকল জ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করতে পারে সে জন্য নিজ উদ্যোগে ওই গ্রামের লেখক কবি মোঃ মহিউদ্দিন নিজ প্রতিষ্ঠা করেন ‘হারুন অর রশিদ স্মৃতি’ পাঠাগার। পাঠাগারটি তার বড় ভাই মরহুম মোঃ হারুন অর রশিদের নামে প্রতিষ্ঠা করেন। হারুন অর রশিদ ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি ১৯৯০ সালের ২৭ মার্চ ঢাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তার স্মৃতি ধরে রাখতে এবং শিক্ষার্থীসহ এলাকার মানোন্নয়ন করতে এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেন লেখক কবি মহিউদ্দিন। এই এলাকার পিছিয়ে পড়া যুবকদের বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বই পড়তে চলে আসেন পাঠাগারে। মোবাইলে আসক্ত হয়ে অলস সময় না কাটিয়ে তারা এখন বই পড়ার আনন্দে উচ্ছ্বসিত। প্রতিদিন বিকাল হলেই বই পড়া, আড্ডায় আর জ্ঞান অর্জনে সময় ব্যয় করেন শিক্ষার্থীসহ মধ্যম বয়সি পাঠকরা। প্রতিদিনই বাড়ছে বইপ্রেমী পাঠকের সংখ্যা।
মেঘনা নদীর কোলঘেষা পাঠাগারটি কথা জানতে পেরে তা পরিদর্শণ করতে আসেন দৌলতখান সরকারী আবু আবদুল্লাহ কলেজের দর্শণ বিভাগের প্রভাষক সঞ্জয় কুমার জোতদার, তজুমদ্দিন সরকারী ডিগ্রী কলেজের দর্শণ বিভাগের প্রভাষক মিলি বাসক। তারা লেখক কবি মহিউদ্দিনের একক প্রচেষ্টায় পাঠাগারটি দেখে অভিভুত হয়েছেন। তারা বলছেন প্রত্যন্ত গ্রামে এমন একটা পাঠাগার হবে এটা কল্পনাতিত। এখানে দেশের খ্যাতনামা অনেক লেখকের বই দেখতে পেয়েছেন। বিকেলবেলা প্রতিনিয়তই শিক্ষার্থী ও মধ্য বয়সি লোকজন পাঠাগারটিতে এসে বই-খবরের কাগজসহ অন্যান্য বিয়য়ের বই পড়ছেন এবং দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারছেন। তারা কবি মহিউদ্দিনের এ প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ভবিষ্যতেও যেন এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে সে প্রত্যাশাও কামান করেছেন।
কথা হয় এলাকার একাদশ শ্রেণীতে পড়–য়া নাঈম নামের এক শিক্ষর্থীর সাথে। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিনই বিকাল বেলা যখন সময় পাই এই পাঠাগারে এসে বই পড়ি। এখানে অনেক বড় বড় কবি-সাহিত্যিকের বই রয়েছে। সেগুলো পড়তে আমার অনেক ভাল লাগে।
কথা হয় একই এলাকার মধ্যম বয়সি আবু সুফিয়ান নামের এক লোকের সাথে। তিনি বলেন, আমাদের এই গ্রামে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম। এলাকার যুব সমাজকে মোবাইল সহ অন্যান্য ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষা করার জন্য মহিউদ্দিন ভাই এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মিত এখানে এসে বইসহ পত্রিকা পড়ি। দেশ-বিদেশসহ সকল বিষয়ে আমরা জানতে পারি।
পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা কবি মোঃ মহিউদ্দিন জানান, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আমাদের বসবাস। আমাদের এ গ্রামটি মেঘনা নদীর কোলঘেষা হওয়ায় শিক্ষার আলো তেমন একটা নেই। পিছিয়ে পড়া গ্রামের শিক্ষার্থীরা যাতে করে শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, গল্প-উপন্যাস, কবিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমান বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে তার জন্য এ ব্যবস্থা করা। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০২৩ সালে ভোলা সদরের ধনিয়া ইউনিয়নের নাছির মাঝি এলাকার শাপলা বাজারে পাঠাগারটি স্থাপন করেন। এখানে বর্তমানে দেশের খ্যাতনামা লেখকদের নানা বিষয়ের প্রায় ২ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। পাঠাগারটি ইতিমধ্যে সরকারি গণগ্রন্থাগারের রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত হয়েছে। সকলের সহযোগিতায় ভবিষ্যতে এটি আরও উন্নত হবে এমন প্রত্যাশা করছেন কবি মহিউদ্দিন ও গ্রামবাসীরা।