ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে প্রতারণা সংক্রান্ত অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে আদানির ১৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে প্রভাব পড়তে পারে।
এছাড়া আদানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে দেশে-বিদেশে বিস্তৃত তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপরেও।যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল প্রসিকিউটররা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার ব্যবসায়িক প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার সময় আদানি এই তথ্য গোপন করেছিলেন যে ওই বরাদ্দ তিনি পেয়েছেন ২৫ কোটি ডলার ঘুষ দিয়ে।
ফেডারেল প্রসিকিউটরদের আরও অভিযোগ, ২০ বছর ধরে ২০০ কোটি ডলারের মুনাফাযুক্ত চুক্তি পেতে আদানি ও তার গোষ্ঠীর কর্মকর্তারা ভারতীয় কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছেন। তবে আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে একে ‘ভিত্তিহীন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কিন্তু এ বিষয়টি ইতোমধ্যে আদানি গোষ্ঠীর পাশাপাশি ভারতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। বৃহস্পতিবার ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বাজার মূল্য খুইয়েছে আদানি গোষ্ঠীর অধীনস্থ সংস্থাগুলো। এর ফলে তার ১০টি সংস্থার কম্বাইন্ড ক্যাপিটাল ক্যাপিটালাইজেশন বা সম্মিলিত বাজার মূলধন ১৪৭০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সংস্থা ‘আদানি গ্রিন এনার্জি’র তরফে জানানো হয়েছে তারা ৬০ কোটি ডলারের বন্ড অফার নিয়ে আর এগোবে না।
এদিকে আদানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রভাব ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতিতে কতটা পড়তে পারে সেই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গে গৌতম আদানির গভীর সংযোগ রয়েছে। দেশটিতে তিনি ১৩টি বন্দর, সাতটি বিমানবন্দর পরিচালনা করেন। এছাড়া ভারতে থঅল দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্টের ব্যবসা রয়েছে। এনার্জি সেক্টরেও তার বড় হাত রয়েছে। তিনি গ্রিন হাইড্রোজেনের খাতে ৫০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া ৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইনও পরিচালনা করে আদানি গোষ্ঠী।
গৌতম আদানির অধীনস্থ সংস্থাগুলো ৪৫ হাজারের বেশি মানুষকে নিয়োগ করলেও তার ব্যবসা দেশব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার তালিকায় রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় কয়লা খনি পরিচালনা, কেনিয়া ও মরক্কোর বিমানবন্দর পরিচালনা ও জ্বালানি প্রকল্প। তানজানিয়া এবং কেনিয়া জুড়ে একশো কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের অবকাঠামোগত প্রকল্পের উপরেও আদানি গোষ্ঠীর নজর রয়েছে।
এদিকে আদানির সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ দুজনেই গুজরাটের অধিবাসী। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন থাকার সময় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আদানির সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করে সমালোচকরা আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ (এমন এক ধরনের অর্থনীতি যেখানে রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে কোনো ব্যক্তি বিশেষ বা গোষ্ঠী অনুগ্রহ লাভ করে বা বিশেষ সুবিধা পায়) হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
এই সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও গৌতম আদানি উন্নতি করেছেন। একইসঙ্গে যে কোনো সফল ব্যবসায়ীর মতো, আদানি অনেক বিরোধী নেতার সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছেন এবং তাদের রাজ্যে বিনিয়োগও করেছেন।
এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালিখি করেছেন ভারতীয় সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা। তিনি বলেন, ‘আদানি এবং মোদি দীর্ঘদিন ধরেই অবিচ্ছেদ্য। এটা ভারতের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে চলেছে।’
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ২০২৩ সালে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে স্টক ম্যানিপুলেশন এবং জালিয়াতির অভিযোগ তোলার পর আদানি নিজের ভাবমূর্তি পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টায় প্রায় দুই বছর ব্যয় করেছেন।
যদিও তার বিরুদ্ধে ওঠা ওই অভিযোগ আদানি অস্বীকার করেছেন। তবে সেই অভিযোগের কারণে মার্কেট সেল-অফ (মার্কেট সেল-অফ হলো বৃহৎ পরিমাণ সিকিউরিটিজের দ্রুত বিক্রয়, যার ফলে তার দাম কমে যায়) হয়েছে এবং সে বিষয়ে ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) তদন্তও করছে।
বাজার বিশ্লেষক অম্বরীশ বালিগা বিবিসিকে বলেন, “এটা যে কতটা গুরুতর তা বাজারে প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যায়। এরপরেও বড় প্রকল্পগুলোর জন্য তহবিল সুরক্ষিত করতে সক্ষম হবে আদানি গোষ্ঠী, তবে একটু বিলম্ব হতে পারে।
তবে সাম্প্রতিক অভিযোগগুলো আদানির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ পরিকল্পনায় একটা বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এ বিষয়ে সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটির লি কং চিয়ান প্রফেসর নির্মাল্য কুমার বলেছেন, ‘এটা (ঘুসের অভিযোগ) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত তার বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বন্ধ করবে।
এদিকে ভারতের বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধী গৌতম আদানিকে গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছেন এবং এই ইস্যু নিয়ে সংসদ তোলপাড় করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
বাজার বিশ্লেষক অম্বরীশ বালিগা বলেন, আদানির বিষয়টি নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে মনে হয় ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা