Dhaka ০৩:২০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্তির পথে ধর্মজাল

দ্বীপজেলা ভোলার চারপাশে নদ-নদী, এ নদী থেকে সংযুক্ত বিভিন্ন খাল। এসব খালে ভেসাল জাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ শিকারের দৃশ্য ছিল সবার চিরচেনা। তবে সময়ের পালাবদলে এ ভেসাল জালে মাছ শিকারের দৃশ্য এখন একটা চোখে পড়ে না। প্রত্যান্ত গ্রামগঞ্জের খাল-বিল, ও ডোবায় বর্ষা মৌসূমে জেলেদের ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যেত একসময়। (ধর্মজাল)-এ উঠতো রুই, কাতলা, পুঁটি, বাইলা, টেংরা, চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ। ভেসাল (ধর্মজাল) ভর্তি মাছ দেখে জেলেরা খুশিতে হতেন আত্মহারা। সময়ের বির্বতনে সেই ঐতিহ্যবাহী ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরা এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। বলা চলে ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরার যে পেশা ছিল তা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তারপরেও গ্রামের কিছু জায়গায় মাঝে মধ্যে ভেসাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়।

জানা গেছে, ভোলার বিভিন্ন এলাকায় ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ শিকার করলেও নদীভাঙ্গন ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ শিকার করছেন সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের কানাইনগর এলাকার মতলব মাঝি। মাছ এখন কম পেলেও পুরানো অভ্যাস কোনোমতেই ছাড়তে পারছেন না।

তিনি জানান, বর্ষার শুরুতে খালে পানি এলেই ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরা শুরু করেন। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মাছ শিকার করতেন। এরপর এক থেকে দুই ঘণ্টা বিরতি রাখেন। তারপর একটানা রাত ৮-৯ টা পর্যন্ত চলে মাছ ধরা। ভেসালে (ধর্মজাল) ওঠা মাছ আশেপাশের হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। স্থানীয় লোকজনও ভেসাল (ধর্মজাল) এর কাছে গিয়ে তরতাজা মাছ কিনে নেয়।

আরো জানা গেছে, খাল-বিলে পানি কম হওয়ায় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। ভেসাল (ধর্মজাল) তৈরি করার জন্য জেলেকে জাল কেনা, ভেসাল (ধমজাল) তৈরি করার জন্য বড় বড় বাঁশ, রশি ও নৌকা কিনতে হতো। আর এ জন্য তাকে গুনতে হতো কয়েক হাজার টাকা। গ্রামে এখন আর আগের মতো বড় বাঁশ দেখা যায় না। তাই দু-চারজন যারা রয়েছেন, তারা বাশের পরিবর্তে সুপারি গাছসহ অন্যান্য গাছ ব্যবহার করছেন।

কথা হয় ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা মাহাজনপোল এলাকার সেরু মাঝি’র সাথে। তিনি জানান, খাল সরু হয়ে যাওয়া, নাব্যতা সংকট, খালে জোয়ারের পানি না আসায় আগের তুলনায় মাছ কমে গেছে। তাই জেলেরা খাল থেকে মাছ ধরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে বিভিন্ন এলাকায় ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরার যে প্রচলন ছিল তা হারিয়ে যাচ্ছে।

ইলিশা পাকার মাথার বাসিন্দা বজলু চৌকিদার বলেন, এখন তো খাল বন্ধ করে মানুষ ব্রীজ করে। প্রতি বাড়ীর সামনেই ব্রীজ। আবার অনেকে অবৈধভাবে খাল ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় ওইসব খালগুলো সরু (চিকন) হয়ে গেছে এবং পানি প্রবাহ কমে গেছে। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় খালগুলো হারিয়েছে নাব্যতা, ঠিক তেমনি কমে গেছে মাছ। এ জন্য খালে পানি কম থাকায় মাছও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তাই জেলেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। খালে বসাচ্ছেন না কোন ভেসাল জাল।

জেলে গৌতম বিশ্বাস বলেন, এখন থেকে ২০-২৫ বছর আগেও প্রায় সারা বছরই ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরতাম। এখন খাল-বিলে পানিও তেমন হয় না, ভেসালে (ধর্মজাল)-এ মাছও ওঠে না। শীত আসার আগ থেকেই খালে পানি থাকে না। বর্ষার দুই-তিন মাস শুধু ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরা যায়। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে বর্তমানে অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছে বলেও জানান তিনি।

ভেসাল (ধর্মজাল) ব্যবহারের মাধ্যমে একজন জেলে খুব সহজে মাছ শিকার করতে পারেন। এর থলি বেশ বড়। জালের সামনের প্রান্ত খাল বা বিলের পানির গভীর ছুঁয়ে মাছকে থলিতে বন্দি করে। তখন জেলে দুই হাত দিয়ে জালে ঢুকে পড়া মাছগুলোকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারেন জেলেরা। এক সময় সারা বছরই দেখা যেতো বিভিন্ন এলাকার খালে ভেসাল জাল পেতে চলছে মাছ ধরা। নানা বয়সী মানুষ এই জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। বর্ষাকাল ছিল মাছ ধরার ভরা মৌসূম। তবে এখন আর সেই দিন নেই। নেই ভেসাল জাল। বর্ষা মৌসূম ছাড়া তেমন দেখা মেলা ভার।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে পরিত্যক্ত লোহা বিক্রি

বিলুপ্তির পথে ধর্মজাল

Update Time : ০৫:৫৭:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

দ্বীপজেলা ভোলার চারপাশে নদ-নদী, এ নদী থেকে সংযুক্ত বিভিন্ন খাল। এসব খালে ভেসাল জাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ শিকারের দৃশ্য ছিল সবার চিরচেনা। তবে সময়ের পালাবদলে এ ভেসাল জালে মাছ শিকারের দৃশ্য এখন একটা চোখে পড়ে না। প্রত্যান্ত গ্রামগঞ্জের খাল-বিল, ও ডোবায় বর্ষা মৌসূমে জেলেদের ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যেত একসময়। (ধর্মজাল)-এ উঠতো রুই, কাতলা, পুঁটি, বাইলা, টেংরা, চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ। ভেসাল (ধর্মজাল) ভর্তি মাছ দেখে জেলেরা খুশিতে হতেন আত্মহারা। সময়ের বির্বতনে সেই ঐতিহ্যবাহী ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরা এখন তেমন একটা চোখে পড়ে না। বলা চলে ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরার যে পেশা ছিল তা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তারপরেও গ্রামের কিছু জায়গায় মাঝে মধ্যে ভেসাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়।

জানা গেছে, ভোলার বিভিন্ন এলাকায় ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ শিকার করলেও নদীভাঙ্গন ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ শিকার করছেন সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের কানাইনগর এলাকার মতলব মাঝি। মাছ এখন কম পেলেও পুরানো অভ্যাস কোনোমতেই ছাড়তে পারছেন না।

তিনি জানান, বর্ষার শুরুতে খালে পানি এলেই ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরা শুরু করেন। প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মাছ শিকার করতেন। এরপর এক থেকে দুই ঘণ্টা বিরতি রাখেন। তারপর একটানা রাত ৮-৯ টা পর্যন্ত চলে মাছ ধরা। ভেসালে (ধর্মজাল) ওঠা মাছ আশেপাশের হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। স্থানীয় লোকজনও ভেসাল (ধর্মজাল) এর কাছে গিয়ে তরতাজা মাছ কিনে নেয়।

আরো জানা গেছে, খাল-বিলে পানি কম হওয়ায় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। ভেসাল (ধর্মজাল) তৈরি করার জন্য জেলেকে জাল কেনা, ভেসাল (ধমজাল) তৈরি করার জন্য বড় বড় বাঁশ, রশি ও নৌকা কিনতে হতো। আর এ জন্য তাকে গুনতে হতো কয়েক হাজার টাকা। গ্রামে এখন আর আগের মতো বড় বাঁশ দেখা যায় না। তাই দু-চারজন যারা রয়েছেন, তারা বাশের পরিবর্তে সুপারি গাছসহ অন্যান্য গাছ ব্যবহার করছেন।

কথা হয় ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা মাহাজনপোল এলাকার সেরু মাঝি’র সাথে। তিনি জানান, খাল সরু হয়ে যাওয়া, নাব্যতা সংকট, খালে জোয়ারের পানি না আসায় আগের তুলনায় মাছ কমে গেছে। তাই জেলেরা খাল থেকে মাছ ধরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে বিভিন্ন এলাকায় ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরার যে প্রচলন ছিল তা হারিয়ে যাচ্ছে।

ইলিশা পাকার মাথার বাসিন্দা বজলু চৌকিদার বলেন, এখন তো খাল বন্ধ করে মানুষ ব্রীজ করে। প্রতি বাড়ীর সামনেই ব্রীজ। আবার অনেকে অবৈধভাবে খাল ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় ওইসব খালগুলো সরু (চিকন) হয়ে গেছে এবং পানি প্রবাহ কমে গেছে। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় খালগুলো হারিয়েছে নাব্যতা, ঠিক তেমনি কমে গেছে মাছ। এ জন্য খালে পানি কম থাকায় মাছও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তাই জেলেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। খালে বসাচ্ছেন না কোন ভেসাল জাল।

জেলে গৌতম বিশ্বাস বলেন, এখন থেকে ২০-২৫ বছর আগেও প্রায় সারা বছরই ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরতাম। এখন খাল-বিলে পানিও তেমন হয় না, ভেসালে (ধর্মজাল)-এ মাছও ওঠে না। শীত আসার আগ থেকেই খালে পানি থাকে না। বর্ষার দুই-তিন মাস শুধু ভেসাল (ধর্মজাল) দিয়ে মাছ ধরা যায়। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে বর্তমানে অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছে বলেও জানান তিনি।

ভেসাল (ধর্মজাল) ব্যবহারের মাধ্যমে একজন জেলে খুব সহজে মাছ শিকার করতে পারেন। এর থলি বেশ বড়। জালের সামনের প্রান্ত খাল বা বিলের পানির গভীর ছুঁয়ে মাছকে থলিতে বন্দি করে। তখন জেলে দুই হাত দিয়ে জালে ঢুকে পড়া মাছগুলোকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারেন জেলেরা। এক সময় সারা বছরই দেখা যেতো বিভিন্ন এলাকার খালে ভেসাল জাল পেতে চলছে মাছ ধরা। নানা বয়সী মানুষ এই জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। বর্ষাকাল ছিল মাছ ধরার ভরা মৌসূম। তবে এখন আর সেই দিন নেই। নেই ভেসাল জাল। বর্ষা মৌসূম ছাড়া তেমন দেখা মেলা ভার।