সমগ্র বিশ্বের ন্যায় উপকুলিয় উপজেলা বাগেরহাটের ফকিরহাটে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সর্বস্তরে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উদ্বেগজনক মাত্রার দূষণ এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। যা তুলনামূলক বেশি ক্ষতি করছে দরিদ্র, পাঁচ বছরের কম শিশু, বয়স্ক এবং নারীদের।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে আগামী দিনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ খাতগুলোর একটি হচ্ছে কৃষি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই জিডিপির ২ শতাংশ হারাবে বাংলাদেশ।
এমন পরিস্থিতিতে মটির দুষণ রুখে উর্বরাশক্তি ধরে রাখতে বাগেরহাটের ফকিরহাটে কৃষি বিভাগ নিয়েছে ভিন্ন উদ্যোগ। রাষায়নিক সারের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য মাটির শক্তি জৈবসার ব্যবহারের প্রতি চাষিদের আগ্রহ বাড়াতে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও পরার্মশ্য দিচ্ছে তারা। উপকুলিয় এলাকায় পানি সংকট সমাধানে টেকসই মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় নবায়ন যোগ্য জৈবসার ভার্মী কম্পোষ্ট বা কেঁচোসার রাশায়নিক সারের ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে ফসল উৎপাদনে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা বলে মনে করেন কৃষি বিভাগ।
বিশেজ্ঞরা মনে করেন, ফসল উৎপাদনে মাটিতে রাষায়নিক সার ও কিটনাশক ব্যবহাবহার করায় গর্ভবর্তী মা ও শিশুসহ সর্বস্থরের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুকি বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। পাশাপাশি রাষায়নিক সার ও কিটনাশনের কারনে পরিবেশ দূষনের ফলে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। মাট্ িও পরিবেশের উপকারি কিটপতঙ্গ মরে গিয়ে ফসল উৎপাদনে ডেকে আনছে বির্পজয়। এসকল ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় জৈবসার ও জৈব বালায়নাশক রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা।
নলধা মৌভোগ ইউনিয়নের উপসহকারি কৃষি মর্ককর্তা বিপ্লব দাশ বলেন, বিভিন্ন ভাবে পরিবেশ দুষনের কারনে জলবায়ু পরিবর্তনে ফসল উৎপাদনে নানা প্রবিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। উপকুলিয় এ জেলায় টেকসই ভেড়িবাধ ও সুইচগেটের অভাবে খরা মৌশুমে লবণ পানিতে প্লাবিত হয়ে মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরিকল্পিত ভাবে পুকুর ও নিচু জমি ভরাটসহ যত্রতত্র কৃষিজমিতে ভেড়িবাাধ দিয়ে মৎস্য ঘের তৈরি করায় জলাবদ্ধতার অভিশাপ যেন পিছু ছাড়ছে না। আর এসকল প্রতিকুলতার মধ্যে কম খরচে অধিক ফসল উৎপাদনে জৈবসার এবং জৈব ও পরিবেশবান্ধব বালায়নাশক দেখাচ্ছে আসার আলো। ইতমধ্যে নলধা মৌভোগ এলাকায় একাধিক কৃষক মাটিতে লবণাাক্ততা রুখে জৈবসার ববহার করে আগাাম গ্রীস্মকালীন টমেটোসহ সবজি উৎপাদন করে ব্যপক লাভবান হয়েছেন। জৈবসার ব্যবহার করায় মাটিতে পানির ধারন কমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে খরচ অনেক কমেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাশিনতায় বাজেট বরাদ্দ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং কাজকর্মে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হিনতায় প্রতিবছর পানির কারনে নানা সমস্যায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বনভুমি কৃষি ফসল ও মাটি। সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে ও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লখ্যে বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় বাঁধন (সিএসও} ব্রাকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সুপেয় পানি চাহিদা মেটাতে কাজ করছে কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। যা প্রয়জনের তুলনায় অনেক কম বলে মন্তব্য করেন ভুক্তভোরা।
কৃষি বিভাগে সবুজ উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করলেও তা অর্থ সংকটে পড়ে আশার আলো দেখেনা। সবুজ বনায়ন তৈরিতে যুবসমাজকে ঐক্যবন্ধ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কাজে লাগাতে হবে বেকার জনগষ্ঠিকে। যার উজ¦ল উদাহরন রয়েছে বেতাগায়। বঙ্গবন্ধু বনায়নের মাধ্যমে বেকার জনগষ্ঠির কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদটি। এমন উদ্যোগ সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া উচিৎ বলে মনে করেন শুশিল সমাজ।
শেখ হেলাল উদ্দীন ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ বটুগোপাল দাশ বলেন, পলিথিন ব্যবহারে সরকারি ভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নিয়ন্ত্রন নেই প্যাকেটজাত পন্যের পলিথিনে। যা সাধারণ পলিব্যাগ থেকে অধিক ক্ষতিকর। যা দ্রুত বন্ধ হওয়া প্রয়জন। তিনি আর বলেন, অবৈধ ভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তলন অপরিকল্পিত গৃহায়ন পানি চলাচল পথ বন্ধ করে বেড়িবাধ দিয়ে মৎস্য ঘের স্থাপন ও নিবিচারে গাছ কাটা বন্ধ হওয়া জরুরি। এছাড়া শুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে পুকুর খনন করে পানি প্রক্রিয়াজাতকরন ট্যাংক স্থাপন ও বৃষ্টি মৌশুমে পানি ধরে রাখার জন্য প্লান্ট স্থাপনে সরকারি উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়জন বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আনা লুইসা গোমেজ লিমা এক প্রতিবেদনে বলেন, “সময়মতো এবং সঠিক নীতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের ধারা পাল্টে ফেলতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষা জোরদারে পদক্ষেপ এবং রান্নায় সবুজ জ্বালানির জন্য বিনিয়োগ ও অন্যান্য প্রণোদনা, সবুজ অর্থায়ন বাড়ানো, কার্যকর কার্বন মার্কেট প্রতিষ্ঠা এবং সচেতনতা বাড়ানো দূষণ কমাতে পারে এবং এর ফলে সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে।”
দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রেন্টমেন্ট অ্যানালাইসিস এর রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ু দূষণ, অনিরাপদ পানি, নিম্নমানের স্যানিটেশন ও হাইজিন এবং সীসা দূষণ বছরে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি অকালমৃত্যুর কারণ। এসব পরিবেশগত কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপির ১৭.৬% সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। ঘরের এবং বাইরের বায়ু দূষণ স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যা ৫৫% অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী এবং যা ২০১৯ সালের জিডিপির ৮.৩২% এর সমপরিমাণ।
পরিবেশ দূষণ শিশুদের ওপর মারাত্বক প্রভাব ফেলছে। সীসা বিষক্রিয়া শিশুদের মস্তিকের বিকাশে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করছে। এর ফলে বছরে প্রাক্কলিত আইকিউ ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০ মিলিয়ন পয়েন্ট। গৃহস্থালিতে কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে রান্না বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস এবং তা নারী ও শিশুদের বেশি ক্ষতি করছে। শিল্পের বর্জ্য এবং অনিয়ন্ত্রিত প্লাষ্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা অপরিশোধিত ময়লাযুক্ত পানির কারণে নদীগুলোর পানি দুষিত হচ্ছে।
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মতাধ্যমে উন্নত পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) এবং সীসা দূষণে প্রতি বছর ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি অকালমৃত্যু ঠেকাতে পারে। সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ,রান্নায় সবুজ জ্বালানি ব্যবহার এবং শিল্প-কারখানা থেকে দূষণ রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বায়ু দূষণ কমাতে পারে।