‘আমার একটা সন্তান ছিলো, আমার সন্তানকে কে বুকের থেকে ছিনাইয়া নিয়া গেলো সেইটাও জানি না। আমার সন্তানকে কে হত্যা করলো সেইটাও জানি না। সংসারে যে একটা বাত্তি জ¦ালাইবো সেই লোকও নাই। একটা ছেলে আছিলো আল্লায় বুকের থেইকা ছিনাইয়া লইয়া গেছে। আমার সংসারের বাত্তি জ¦ালানোর আর কেউ রইলো না। আমার পুতের (ছেলের) খুব মেধা ছিলো পড়ার। নিজে চাকরি-বাকির করতো নিজে পড়াশোনাও করতো। বাপের সংসারে অভাব। নদী ভাঙছে কিছু নাই। চাকরি কইরা ভোলা কলেজে ভর্তি হইছে। ছোটকাল থেকে রক্ত মাংস করলাম। কে ঝড়ায়া দিলো আমার পুতের রক্ত। আমি একটা ছেলে পাইয়া আল্লার কাছে বড় খুশি হইছিলাম। কিন্তু আল্লায় লইয়া গেলো বুকের থেকে ছিনায়া’। কান্না জড়িত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের উত্তর বাটামারা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ বিবি ফাতেমা। তাঁর ছেলেহারা কান্নায় আশপাশের লোকজনও শোকে স্তদ্ধ হয়ে চোখের পানি ফেলছেন। সন্তানহারা মাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা নেই কারো কাছে।
গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তাঁর ছেলে মো. নাহিদুল ইসলাম (২১)। নাহিদ ভোলা সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি সে ঢাকায় বিকাশে চাকরি করতেন ও অবসর সময়ে বিকেল বেলা ফুটপাতে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করতেন। নাহিদুল ইসলাম বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের উত্তর বাটামারা গ্রামের আব্দুল জলিলের একমাত্র ছেলে। ৩ন মেয়ে ১ ছেলের মধ্যে নাহিদ ছিলো সবার ছোট।
নাহিদুল ইসলাম দৌলতখান হাজিপুর মাদ্রসা থেকে ২০২৩ সালে আলিম পাশ করেন। পরে ভোলা সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। গত দুই বছর আগে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে চাকরির খোঁজে ঢাকায় পাড়ি জমায়। ঢাকার মিরপুর-৬ নম্বরে থাকতেন। সেখানে থেকে মোবাইল ব্যাকিং বিকাশে চাকরি করতেন। বিকেল বেলা অবসর সময়ে মিরপুর-১০ নম্বরের ফুটপাতে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করতেন। নিজে ইনকাম করে পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি বাবা-মায়ের সংসারেও খরচ দিতেন। আশা ছিলো পাড়ালেখা করে ভালো কোনো যায়গায় চাকরি করে দরিদ্রতা দূর করে বাবা-মার মুখে হাঁসি ফোটাবেন। কিন্তু সেটি আর হলো না; বুলেটের আঘাতে অকালেই নিভে গেল নাহিদের জীবন প্রদীপ। নাহিদের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনসহ সবাই শোকে স্তদ্ধ।
নাহিদের দিনমজুর বাবা আব্দুল জলিল বেপারী জানান, তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাহিদ সবার ছোট। গত ১০-১২ বছর পূর্বে মেঘনার ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। ১০ শতাংশ জমি কিনে ছোট একটি টিনের ঘরে কোনো মতে বসবাস তাদের। তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। নিজে একটি স্ব-মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু বার্ধক্য জনিত কারনে ঠিকমতো কাজও করতে পারেন না। ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরি ও ব্যবসা করে সংসারে সহযোগীতা করতেন। নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাতেন। গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেল ৩টার দিকে বাবার সাথে মুঠোফোনে কথা হয় নাহিদের। ছেলেকে বলেছিলেন, বাহিরে ঝামেলা চলে বাসা থেকে বের হওয়ার দরাকার নাই। এ কথাই ছেলের সাথে শেষ কথা। বিকেল ৫টার দিকে খবর আসে নাহিদের বুকে গুলি লেগে মারা গেছে। এর পর নাহিদের সাথে থাকা লোকজনের কাছে জানতে পারেন বিকেলের দিকে সাথের লোকজনের সাথে বাহিরে চা খেতে যান। চা খেয়ে বাসায় ফেরার পথে মিরপুর-১০ নম্বরের গোল চত্বরের কাছে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয় নাহিদ। সাথে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সাথের লোকজনই বাড়িতে খবর দিয়ে একটি লাশবাহী গাড়িতে তুলে শনিবার সকালে বাড়িতে এনে সকাল ১০টার দিকে জানাযা শেষে বাড়ির পাশের মসজিদের কাছে দাফন করা হয়।
আব্দুল জলিল আরো জানান, তিনি নিজে স্ব-মিলে শ্রমিকের কাজ করতেন ও ছেলে পাঠানো টাকায় তার সংসার চলতো। ছেলেই ছিলো তাদের একমাত্র ভরসা। সেই ছেলেকে বিনা অপরাধে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন আর তাদের চলার মতো কোনো উপায় নেই। তারা ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেন।
বড় মানিকা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন জানান, আব্দুল জলিল খুব অসহায়। মেঘনার নদীর ভাঙনে ঘরভিটাসহ সকল সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব। কোনো মতে নিজে দিনমজুরি করে ও ছেলের দেয়া টাকায় সংসার চলতো। ছেলের অকাল মৃত্যু হওয়ায় এখন আর তাদের চলার মতো উপায় নেই।