ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও বাণিজ্য ক্ষেত্রে তেমন কোন অসুবিধা হবে না। প্রয়োজনে বিকল্প কোন দেশ থেকে আমাদের পণ্য ক্রয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। আদানির সাথে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিটি বিতর্কিত ও একপক্ষীয় হয়েছে। জনগণকে পাশ কাটিয়ে এই চুক্তি করা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়নি।
আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি অবস্থা বিবেচনায় টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে, এই টাকা কোনভাবেই ঋণ বা ব্যবসায়িক কাজে লাগানো যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী বর্তমান এবং পূর্বতন কোন সরকারি কর্মকর্তা গভর্ণর কিংবা ডেপুটি গভর্ণর হতে পারে না। তারপরও আমরা দেখি অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সেখানে আমলাদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরাধ করে শাস্তি না পেয়ে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে শোষণ ও দুর্নীতির পালাবদল চলতে থাকবে।
চলমান ব্যাংকগুলোতে এত সমস্যা থাকার পরেও বিগত সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ডিজিটাল ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। যেখানে স্বজনপ্রীতিই ছিল মূখ্য।আজ (০৮ডিসেম্বর, ২০২৪রবিবার) রাজধানীর এফডিসিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসিআয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এসব কথা বলে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বিগত ১৫ বছরের শাসন আমলে আর্থিক খাতকে চোরতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করলেও পতিত সরকারের আমলে শুধু চোরতন্ত্র নয়, তারা দখলতন্ত্র, লুটতন্ত্রসহ ডাকাততন্ত্র কায়েম করেছিল। পতিত সরকারের শাসন আমলে পাচারকৃত ২৩৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ৭৫ থেকে ৮০টি পদ্মা সেতু নির্মান করা যেতো। খেলাপিকৃত ঋণ ৩ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল ও আরো ২৪টি পদ্মাসেতুর মতো প্রকল্প নির্মাণ করা যেতো। খেলাপি ঋণে পিছিয়ে নেই রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোও। রাষ্ট্রায়ত্ব লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের বোঝা যা দাঁড়িয়েছে, তা কেয়ামত পর্যন্ত শোধ করা যাবে না।বিগত সময়ে আমরা দেখেছি ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন পাঁচ তারকা হোটেলে বসে সুদহার ও ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিতো। আর সেই সুদ হার ও ডলারের মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংক মেনে নিতো। আমাদের জন্য বড় দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে রাজনীতিবিদরাই ব্যবসায়ী, তারাই ব্যাংকের মালিক, আবার মিডিয়া হাউজেরও মালিক। যিনি কর খেলাপি, তিনিই ঋণ খেলাপি আবার তিনিই অর্থ পাচারকারী। ফলে দেশে সুশাসনের অভাব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশে ঋণখেলাপীদের সামাজিকভাবে বর্জন করা হয়। তারা ব্যবসা বাণিজ্য, বাড়িভাড়া এমনকি পেট্রোল পাম্পে তেলও নিতে পারেনা। অথচ আমাদের দেশে ঋণখেলাপী ও অর্থ পাচারকারীরা এয়ারপোর্টে ভিআইপি হিসেবে যাতায়াত করে। রাষ্ট্রীয় সফরে প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি বসে ভ্রমণ করে।
জনাব কিরণ আরো বলেন, গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন দুই সেনাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও তৎকালীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তারা দুজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছে।বিগত সময়ের এই ডাকাতরা বিদ্যুৎ খাতে ৬ বিলিয়ন ডলার নয় ছয় করেছে। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার শুধু ঘুষ নিয়েছে পতিত প্রধানমন্ত্রীর পরিবার ও তার দোসররা।বিদ্যুতের এমন মিটার বসিয়েছে আওয়ামী সরকার বাতি না জ্বললেও মিটার ঘোরে। প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করার সাথে সাথে এক চতুর্থাংশ টাকা মিটার খেয়ে ফেলে। শিল্প কারখানাগুলোতে গ্যাসের পাইপে গ্যাসের পরিবর্তে বাতাস দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফেরি করে বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলা হলেও বিদ্যুতের ফেরিওয়ালারা এখন সব পলাতক। অনেকে মনে করেন আদানি বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। আমি মনে করি আদানির সাথে আমাদের বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল হলে বাংলাদেশ বেঁচে যাবে।ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে টানাপোড়েন চলছে, তা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আমাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এক সময়ে আমরা ভারতে গরুর ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন আমরা পুশুপালনে স্বয়ংসম্পুর্ণ। ভারতীয় পেঁয়াজ, আলু, সুতাসহ যেসব পণ্য আমরা আমদানি করি তা বন্ধ হলে বাংলাদেশ খুব বেশি বিপদে পড়বে না। এখন থেকে আমরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পুর্ণ হবো অথবা বিকল্প আমদানীর পথ বের করতে হবে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। প্রতিবছর আমাদের দেশের মানুষ স্বাস্থ সেবা নিতে ভারতে গিয়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। আমরা উদ্যোগ নিলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আমরা থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি নিতে পারবো। সুতরাং ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য বা সেবা খাতে কোন টানাপেড়েন দীর্ঘায়িত হলে সেটি বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হবে।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে “আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাবই দুর্নীতি প্রতিরোধে বড় চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক ছায়া সংসদে বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটিকেবিতার্কিকদের পরাজিত করে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিবিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক মোঃ তৌহিদুল ইসলাম, সাংবাদিক জাকির হোসেন ও সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।