সিরাজগঞ্জের বড়পুল। শতাব্দি কালের সাক্ষী। শহরের ভূমি থেকে কমপক্ষে ২৫-৩০ ফুট উঁচু। বড়পুলের চুড়ায় দাঁড়ালে গোটা শহর দেখা যায়। রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে এই বড়পুল নোম্যান্স ল্যান্ডে পরিণত হয়। যেদল বড়পুলের চুড়ায় ওঠে তারাই যেন সংঘর্ষে বিজয়ী হয়। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের সাথে আওয়ামীলীগ কর্মীদের এবং বর্তমানে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে বড়পুলের চুড়া দখলকরা যেন মুল বিষয় হয়ে ওঠে। ১৩২ বছর আগে নির্মাণকালেএই বড়পুলের নাম ছিল ইলিয়ট ব্রীজ।
এই ব্রীজ সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বড়পুল হিসাবে পরিচিত। বড়পুল হিসাবে পরিচিতি পাবারও রয়েছে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ১৮৯২ সালে যখন এই ব্রীজটি নির্মাণ করা হয় তখন প্রমত্তা যমুনার শাখা নদী ছিল সিরাজগঞ্জ শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া হুড়া সাগর নদী। সিরাজগঞ্জ শহরের প্রথম, এবং একমাত্র বড় এই ব্রীজটি নির্মাণের পর হুড়া সাগর নদীর দু’পারের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয় । এর আগে সিরাজগঞ্জ শহরটি মূলত হুড়া সাগর নদী দ্বারা বিভক্ত ছিল। নৌকা ছাড়া পারাপারের কোন সুযোগ ছিলনা । এ নদী দিয়ে তখন চলাচল করেছে বড় বড় লঞ্চ, ষ্টিমার এবং বড় বড় পাল তোলা নৌকা। এমনি সময়ের কোন এক বিকালে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন ইংরেজ মহুকুমা প্রশাসক বিটসন বেল শহরের পশ্চিম পার হতে পূর্ব পারে তার আবাস স্থলে যাচ্ছিলেন, পথে এক দুস্থ মানুষের আর্তনাদ তাকে দারুন ভাবে নাড়া দেয় ।
তিনি দেখেন একজন দুঃস্থ লোক নদী পার হবার জন্য মাঝির নিকট করন ভাবে আবেদন নিবেদন করছে । কিন্তু মাঝি তাকে বিনা পয়সায় নদী পার করতে নারাজ । তিনি জানতে পারেন অভাবী ওই মানুষটি তাঁর পুরোদিনের উপার্জন দিয়ে পরিবারের জন্য খাদ্য সামগ্রী কেনায় তার হাতে কোন অবশিষ্ট টাকা নেই । অপর দিকে নদী পার হতে না পারলে সে বাড়ি পৌঁছাতে পারবেনা । অনাহারে থাকবে পরিবারের লোকজন। এমন অবস্থায় বিটসন বেল’র অনুরোধে মাঝি দুস্থ লোকটিকে নদী পার করে দেয়। এ ঘটনার পরই বেল নদীর উপর ব্রীজ নির্মাণের উদ্দ্যোগী হন। গঠন করেন ব্রীজ নির্মান কমিটি। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চাঁদা তুলে তহবিল গঠন শুরু করেন। এক পর্যায়ে তৎকালীন পাবনা জেলা বোর্ড, ব্রীজ নির্মাণের সহযোগিতা স্বরূপ ১৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করেছিলেন ।
তবে এই ব্রীজ নির্মাণে মোট কত টাকা ব্যয় হয়েছিল তার সঠিক কোন হিসাব আজও জানা যায়নি। প্রবীণদের ধারনা এই ব্রীজ নির্মানে প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল । এই ব্রীজ নির্মাণ করে পাটাতন দেয়া হয়েছিল শাল কাঠের তক্তা দিয়ে । পরে তা কংক্রিট সিমেন্ট বা সিসি ঢালাই করা হয়। ১৮৯২ সালের ৬ আগষ্ট তৎকালীন বাংলা ও আসামের গভর্নর স্যার চার্লস ইলিয়ট ব্রীজটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরে তাঁর নামানুসারে ইতিহাস সমৃদ্ধ এই ব্রীজটির নাম করণ করা হয় ইলিয়ট ব্রীজ । সেই সময়ের ১৮০ ফুট দীর্ঘ ও ১৬ ফুট প্রস্থের এই ব্রীজটি ছিল অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। মূলত এ কারনেই সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ এটিকে বড়পুল হিসাবে অলিখিত ভাবে নামকরণ করে। হুড়া সাগর নদী অনেক আগেই তার গৌরব হারিয়েছে । সংযোগবিচিছন্ন হয়েছে যমুনার সাথে। প্রভাবশালীদের দখলে এখন কাটাখালিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কালের সাক্ষী হিসাবে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সৌন্দর্য মন্ডিত, ইতিহাস সমৃদ্ধ সেই ইলিয়ট ব্রীজ তথা বড়পুল।
পাকিস্তান আমলে বড়পুলের পূর্বপারে ছিল মুসলিমলীগের দলীয় অফিস। পশ্চিমপারে ছিল আওয়ামীলীগের দলীয় অফিস। বর্তমানে পুর্বপারে অবস্থিত বিএনপি’র দলীয় অফিস। একারনেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডও চলে বড়পুলের এপার- ওপারকে ঘিরে। তবে বড়পুলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিয়মিত ভাবে ব্রীজটির সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কারের অভাবে ব্রীজের গোড়ার দিকের অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দখল হয়েছে ব্রীজের আশে-পাশের অনেক জায়গা। নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষণ না করলে হয়ত একদিন এই বড় পুল ধ্বংস হয়ে যাবে। এবিষয়ে সিরাজগঞ্জ পৌরনভার সচিব মো.লুৎফর রহমান জানান,ইলিয়ট ব্রীচ সিরাজগঞ্জের একটি প্রাচীন স্থাপনার মধ্যে অন্যতম। এটিকে টিকিয়ে রাখতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।