রেলকারখানার মালামাল বুঝে না নিয়েই দুই ঠিকাদারকে সম্পূর্ণ বিল পেমেন্ট করে দেয়া হয়েছে । ফলে মালামাল সরবরাহ না করায় কাঁচামাল সংকটে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে দুই দিন বন্ধ ছিল আউট টার্ন। এমন অভিযোগের তদন্তের পর প্রকৃত দুর্নীতিবাজকে শাস্তি না দিয়ে উল্টো কারখানার উচ্চমান সহকারীকে অনত্র বদলী করে অনিয়ম ও দুর্নীতি আড়াল করার চেষ্টা করেছেন করাখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক। এমন অভিযোগ করেন ওই কারখানায় কর্মরত একাধিক ঠিকাদার।
জানা যায়, ২৪ এর জুলাই-এর গণঅভূত্থানে পট পরিবর্তনের পর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাতেও নতুন অভিভাবকের আগমন ঘটে। কারখানটির সর্বোচ্চ বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) পদে আসেন মোস্তফা জাকির হাসান। তিনি আসার পর গত অক্টোবর মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ অভ্যন্তরীন টেন্ডারের মাধ্যমে বন্টন করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৮ কোটি টাকার কাজ পান দুই ঠিকাদার। বাকী ২ কোটি টাকার কাজ দেয়া হয় ৪ ঠিকাদারকে। কমিশন চুক্তিতে কারখানার ডিএস তার পছন্দনীয় ঠিকাদার ডিসেন ও সাহিন নামের ২ ঠিকাদারকে বেশি কাজ দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালামাল সরবরাহ শেষ না করেও সমুদয় বিল পরিশোধ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এতে সংশ্লিষ্ট সপগুলোর ইনচার্জসহ মালামাল দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও কমিশন নিয়ে অগ্রীম মালামাল বুঝে পাওয়ার স্বাক্ষর (ক্লিয়ারেন্স) করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে নতুন যোগদানকারী ওয়ার্ক ম্যানেজারকে আড়ালে রেখে উৎপাদন প্রকৌশলীকে দিয়ে এই অপকর্ম সম্পাদন করা হয়েছে। এ ঘটনায় শহর জুড়ে আলোচনা শুরু হলে তদন্ত হয়। ঢাকাস্থ রেলভবন থেকে আগত তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এ অনিয়মের বিরোধিতাকারী অফিসারটি উচ্চমান সহকারী সাইফুল ইসলামকে বদলীর মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে দুর্নীতির সাথে জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয় নাই বলে অভিযোগ ঠিকাদারদের।
রেল কারখানার একটি সুত্র জানায়, কারখানার স্বাভাবিক উৎপাদন সচল করতে এল. টি.এম এর ১০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য টেন্ডার দেয়া হয় । ওই টেন্ডারে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঠিকাদারকে কাজ না দিয়ে সরিফুল ইসলাম ডিসেন্ট নামের স্থানীয় এক ঠিকাদার তার ডিসেন্ট এন্টারপ্রাইজ ও ইসলাম এন্টারপ্রাইজ নামে ২ টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একাই প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন। তিনি স্থানীয় বিএনপি’র একজন নেতার আত্মীয় হওয়ায় এবং ডিএসকে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করে কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। একইভাবে কোর ইঞ্জিনিয়ারিং ও কোর এন্টারপ্রাইজ কমিশন দিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী গাইবান্ধার ঠিকাদার সাদিকুর রহমান শাহিনও একাই প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ও লিজা এন্টারপ্রাইজের নতুন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকেপ্রদান করেন ৭০ লক্ষ টাকার কাজ।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, তারা কেউই এত টাকার কাজ পাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নয়। শুধু কমিশন ৩৫% দেওয়ায় তাদের কাজ দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ঠিকাদারদের অভিযোগ দশ ভাগ কমিশন দিয়ে কাজ নেয়ার সময় বিল একাউন্টস অফিস থেকে পাশ হয়েছে। তবে চেকটি জিম্মায় নিয়ে আরও অতিরিক্ত ত্রিশ ভাগ কমিশন দাবী করছেন কারখানাটির বিভাগীয় তত্বাবধায়ক।
ঠিকাদার সাদিকুর রহমান শাহিন বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পে একাধিক কাজ পেয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোন মালামাল সরবরাহ করা হয়নি। কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন দুর্নীতি করা হয়েছে কি-না তা আমার জানা নাই। আর বিল অনিয়ম বা দুর্নীতি পরিশোধের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সঠিক নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার জানান, মালামাল সরবরাহ না করেই বিল প্রদান করা হয়েছে। আর এ কাজে সহায়কের ভুমিকায় ছিলেন হিসাব বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকতারাও। শুধু নতুন যোগদানকারী কর্ম ব্যাবস্থাপককে আড়ালে রেখে উৎপাদন প্রকৌশলীকে দিয়ে এই অপকর্ম সম্পাদন করা হয়েছে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা রেল ভবন থেকে ৯ জানুয়ারী একটি তদন্ত টিম আসে সৈয়দপুর রেল কারখানায়। তবে সেই তদন্ত কর্মকর্তাকেও ম্যানেজ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
ঢাকাস্থ রেলভবনের যুগ্ম মহাপরিচালক (ম্যাকানিক্যাল) রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাকে ডিজি পাঠিয়েছিলেন তদন্তে। আমি তদন্তের পর প্রতিবেদন দাখিল করেছি। তবে কর্মকতাদের এমন পুকুর চুরির ঘটনা প্রকাশ হওয়ায় ডিএস এর অফিস ক্লার্ক সাইফুল ইসলামের ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে ১৩ জানুয়ারী শাস্তিমূলক বদলী করা হয় পাকশীতে। এর প্রতিবাদে ১৯ জানুয়ারী ঠিকাদাররা ডিএস এর কার্যালয় ঘেরাও প্রতিবাদ করেন। তবে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ডিএস মোস্তফা জাকির হাসান। তিনি নিজেকে তারেক রহমানের ঘনিষ্টজন বলে দাবী করেন। তাই তার বিরুদ্ধে বলার কেউ নেই।
সৈয়দপুর রেলওয়ে হিসাব বিভাগের হিসাব রক্ষক রেজা হাসান বলেন, টেন্ডার দেয়া ও পাওয়া বিষয়ে ডিএস স্যারই ভালো বলতে পারবেন। ঠিকাদারদের বিল পরিশোধের বিষয়ে তার নির্দেশনাই আমরা পালন করি। তাই তিনি যাদের বিল দিতে বলেছেন তাদের বিল দেয়া হয়েছে। এসংক্রান্ত কোন তথ্য আমি দিতে পারবোনা। আমার উপর আরও দুইজন কর্মকর্তা রয়েছেন। আর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার উচ্চমান সহকারী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সাইফুল ইসলামকে আমি বদলী করিনি।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএসডাব্লিউ) মোস্তফা জাকির হাসান বলেন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের বাড়ীর সংলগ্ন আমার বাড়ী। আমার বিরুদ্ধে যেই মিথ্যা অভিযোগ তুলুক না কেন আমি তা পরোওয়া করি না। তিনি আরো বলেন, শুধু ৫ ঠিকাদার নয়, প্রায় ২৫টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০ কোটি টাকার কাজ ২ জন নিতীবান ঠিকাদারকে দেয়া হয়েছে। আর মালামাল সরবরাহ না দিয়ে বিল দেয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। এটি মিথ্যা বানোয়াট ও ভিত্তিহীন । বরং অনেকে মালামাল দিয়েও বিল পায়নি। এতে আউট টার্নের কোন প্রভাব পরবে না বলে জানান তিনি।