Dhaka ০৬:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দিন দিন কমে যাচ্ছে গ্রামীণ সালিশ-বিচার

Exif_JPEG_420

বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জ পাড়া মহল্লায় ঘটে যাওয়া ছোটখাটো ঝগড়া বিবাদ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ মাতাব্বরগণ মিলে সালিশ বা বিচার বৈঠকের  মাধ্যমে মীমাংসা করে দেন। পারিবারিক কিংবা সামাজিক ঝগড়া বিবাদের সুষ্ঠু মীমাংসা করাই এই সালিশি বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য। কোন কোন অঞ্চলে একে পঞ্চায়েত বলা হয়। মাতাব্বরগণ একটি নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের কথা শুনে বিভিন্ন যুক্তি তর্কের পর সালিশের পূর্বে নির্ধারিত সভাপতি বিজোড় সংখ্যক লোক দিয়ে একটি ‘জুড়ি বোর্ড’ গঠন করেন। গঠিত ‘জুড়ি বোর্ড’ সালিশের রায় নির্ধারণ করে সভাপতি কে জানান।

সভাপতি তখন তা কার্যকর করার ব্যবস্থা করেন। এ জাতীয় রায়ে বেত্রাঘাত, কিছু অর্থদণ্ড অথবা মাপ মুক্তির মাধ্যমে ঝগড়ার মীমাংসা হয়ে থাকে। নব্বই দশক পর্যন্ত গ্রামীণ এই সালিশ-বিচার ব্যবস্থা ব্যাপক প্রচলন থাকলেও বর্তমানে এই ব্যবস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ‘গ্রাম সরকার’ গঠনের মাধ্যমে এই সালিশি ব্যবস্থা সচল রাখেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ‘গ্রাম সরকার’ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ইউনিয়ন পরিষদে ‘গ্রাম আদালত’ গঠনের মাধ্যমে এই সালিশ-বিচার ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখতে উদ্যোগী হন। এতেও তেমন সাড়া মেলেনি।

কেন গ্রাম বাংলার এই সালিশ বা বিচার ব্যবস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ওসি মোশারফ হোসেন পুলিশের প্রতি আস্থা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অভিযোগ নিয়ে থানায় আসেন বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ভিকটিমের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের পর ছোটখাটো বিষয়গুলো আমরা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে মীমাংসা করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, নাগরপুর উপজেলার সমাজ সেবা কর্মকর্তা এবং একটি ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক মোবারক হোসেন তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে সমঝোতার মনোভাব কম। বেশিরভাগ মানুষ চায় প্রতিপক্ষের শাস্তি নিশ্চিত করা। গ্রামীন বিচার-সালিশে যেটা সম্ভব নয়।

গ্রাম্য বিচার সালিশের মূল উদ্দেশ্যই থাকে সমঝোতা। এ সকল কারণেই মানুষ থানা এবং আদালতের দিকে বেশি ঝুঁকে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারসহ সকল স্টাফদের গ্রাম আদালতের বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে গ্রাম আদালত সক্রিয় করার পক্ষে তিনি মত দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান বলেন ,পক্ষপাত মূলক বিচার, মাতব্বরদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, থানা এবং জেলা পর্যায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়া গ্রামীন সালিশ বা বিচার ব্যবস্থা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

ছোটখাটো ঘটনায় গ্রামীন সালিশি ব্যবস্থা অসহায় দরিদ্র মানুষদের জন্য ন্যায্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে করে থানা এবং আদালতের উপর চাপ কমবে। তিনি গ্রামের সর্বজন গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ‘গ্রাম সরকার’ গঠনের মাধ্যমে গ্রামীণ সালিশ বা বিচার ব্যবস্থাকে পুন:রায় সক্রিয় রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। গ্রামের সুশীল সমাজ মনে করেন, গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য ছোটখাটো ঘটনায় ন্যায্য বিচারের লক্ষ্যে গ্রামীণ সালিশি ব্যবস্থার প্রচলন খুবই দরকার। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারিভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

ছয় সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ওয়েব সাইটে প্রকাশ

দিন দিন কমে যাচ্ছে গ্রামীণ সালিশ-বিচার

Update Time : ০৫:১৭:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জ পাড়া মহল্লায় ঘটে যাওয়া ছোটখাটো ঝগড়া বিবাদ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ মাতাব্বরগণ মিলে সালিশ বা বিচার বৈঠকের  মাধ্যমে মীমাংসা করে দেন। পারিবারিক কিংবা সামাজিক ঝগড়া বিবাদের সুষ্ঠু মীমাংসা করাই এই সালিশি বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য। কোন কোন অঞ্চলে একে পঞ্চায়েত বলা হয়। মাতাব্বরগণ একটি নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের কথা শুনে বিভিন্ন যুক্তি তর্কের পর সালিশের পূর্বে নির্ধারিত সভাপতি বিজোড় সংখ্যক লোক দিয়ে একটি ‘জুড়ি বোর্ড’ গঠন করেন। গঠিত ‘জুড়ি বোর্ড’ সালিশের রায় নির্ধারণ করে সভাপতি কে জানান।

সভাপতি তখন তা কার্যকর করার ব্যবস্থা করেন। এ জাতীয় রায়ে বেত্রাঘাত, কিছু অর্থদণ্ড অথবা মাপ মুক্তির মাধ্যমে ঝগড়ার মীমাংসা হয়ে থাকে। নব্বই দশক পর্যন্ত গ্রামীণ এই সালিশ-বিচার ব্যবস্থা ব্যাপক প্রচলন থাকলেও বর্তমানে এই ব্যবস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ‘গ্রাম সরকার’ গঠনের মাধ্যমে এই সালিশি ব্যবস্থা সচল রাখেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ‘গ্রাম সরকার’ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ইউনিয়ন পরিষদে ‘গ্রাম আদালত’ গঠনের মাধ্যমে এই সালিশ-বিচার ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখতে উদ্যোগী হন। এতেও তেমন সাড়া মেলেনি।

কেন গ্রাম বাংলার এই সালিশ বা বিচার ব্যবস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ওসি মোশারফ হোসেন পুলিশের প্রতি আস্থা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অভিযোগ নিয়ে থানায় আসেন বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ভিকটিমের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের পর ছোটখাটো বিষয়গুলো আমরা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে মীমাংসা করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, নাগরপুর উপজেলার সমাজ সেবা কর্মকর্তা এবং একটি ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক মোবারক হোসেন তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে সমঝোতার মনোভাব কম। বেশিরভাগ মানুষ চায় প্রতিপক্ষের শাস্তি নিশ্চিত করা। গ্রামীন বিচার-সালিশে যেটা সম্ভব নয়।

গ্রাম্য বিচার সালিশের মূল উদ্দেশ্যই থাকে সমঝোতা। এ সকল কারণেই মানুষ থানা এবং আদালতের দিকে বেশি ঝুঁকে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারসহ সকল স্টাফদের গ্রাম আদালতের বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে গ্রাম আদালত সক্রিয় করার পক্ষে তিনি মত দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান বলেন ,পক্ষপাত মূলক বিচার, মাতব্বরদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, থানা এবং জেলা পর্যায়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়া গ্রামীন সালিশ বা বিচার ব্যবস্থা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

ছোটখাটো ঘটনায় গ্রামীন সালিশি ব্যবস্থা অসহায় দরিদ্র মানুষদের জন্য ন্যায্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে করে থানা এবং আদালতের উপর চাপ কমবে। তিনি গ্রামের সর্বজন গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ‘গ্রাম সরকার’ গঠনের মাধ্যমে গ্রামীণ সালিশ বা বিচার ব্যবস্থাকে পুন:রায় সক্রিয় রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। গ্রামের সুশীল সমাজ মনে করেন, গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য ছোটখাটো ঘটনায় ন্যায্য বিচারের লক্ষ্যে গ্রামীণ সালিশি ব্যবস্থার প্রচলন খুবই দরকার। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারিভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।