বাংলাদেশ জামায়াতের ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার অন্তবর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, নির্বাচন আপনি দিবেন তার আগে সংস্কার করুন। কারণ সংস্কারের দাবী উঠেছে, আমরাও সংস্কার চাই। কিন্তু দেশের এত বড় সংস্কার অল্প সময়ে সম্ভব নয়। জনগণের নির্বাচিত সরকারই সব সংস্কার কবে। তবে, একটা ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচন করার জন্য যে বিভাগুগলো সম্পৃক্ত সে কয়টা সংস্কার প্রয়োজন। সেগুলো সংস্কার না করে নির্বাচন দিলে তা নিরপেক্ষ হবে না। তা না হলে সেই ১৪, ১৮ এবং ২৪ মত নির্বাচন হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, কেউ কেউ বলছেন কোন সংস্কার প্রয়োজন নেই। সংস্কার হলো কন্টিনিউয়াস প্রসেস। সংস্কার আর নির্বাচন এক সাথে হবে। এ কথার মধ্যে আমরা অন্য গন্থ পাই। দেশে একন যে সংস্কার চলছে তা আগামী ৬ মাসের মধ্যে এই সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোর স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় করার মাধ্যমে ৬ মাসের মধ্যেই সংস্কার করা সম্ভব। এরপর আপনি জাতীয় নির্বাচনের রোড-ম্যাপ ঘোষণা করুন। তাতে যতটুকু সময় লাগে, লাগুগ। আমরা যদি একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য ১৬ বছর অপেক্ষা করতে পারি, তা হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য দু-চার মাস আগে কিংবা পরে তা কোন ব্যাপার না। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটা নিরপেক্ষ হবে কি না। ততটুকু সময় দিতে জামায়াতে ইসলামী রাজি আছে। তবে এই নির্বাচনের আগে মানবতা বিরোধীদের বিচার করতে হবে এটা জনগণের দাবী। শনিবার (২৫ জানুয়ারী) দুপুরে ভোলায় সরকারী স্কুল মাঠে জামায়াতের জেলা কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ সব কথা বলেন তিনি।
প্রধান অতিথি বলেন, জুলাই-আগষ্ট অভ্যুত্থানের বিপ্লবে যারা নিহত হয়েছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। কারণ এই জুলাই বিপ্লব না হলে আজকের এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে আপনারা-আমরা আসতে পারতাম না। সেই গণঅভ্যুত্থানে ভোলার ৫২ জন ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের আকজের নতুন বাংলাদেশ।
গোলাম পরওয়ার বলেন, ফ্যাসিষ্ট হাসিনা জুলাই-আগষ্ট অভ্যুত্থানে ২ হাজার ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। প্রায় ৪০ হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত করা হয়েছে। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো চোখ নেই। আহতদের দেখতে গিয়ে আমরা সান্তনা দেয়ারও ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। অনেকের মাথার মগজও বেরিয়ে গেছে। নিহত ও আহতদের এই ত্যাগের কারণে আজ আমরা নতুন বাংলাদেশে পেয়েছি, কথা বলতে পারছি, নিঃশ্বাস নিতে পারছি। প্রায় ১৭ বছরের স্বৈরশাসনের, কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিষ্ট, অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে আল্লাহ তায়ালা ৫ই আগষ্ট আসমান থেকে এক মেহেরবানী নাজিল করে জনগণের বুকের উপর চেঁপে থাক জগদ্ধল পাথরকে অপসারন করেছেন। যার কারণে আমরা আজ মুক্ত, স্বাধীন ও নতুন বাংলাদেশে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা একটি দীর্ঘ কালো যুগ পার করে এসেছি এই স্বাধীন বাংলাদেশে। ২০০৬ সালের ২৮ শে অক্টোবর পল্টনে লগি-বইঠা দিয়ে জামায়াতে ইসলামী-ছাত্রশিবিরের ৬জন নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা শাপের মত পিটিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। এমনকি আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মৃত লাশের উপর উঠেও নৃত্য করেছে। সেই দিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারায়, গণতন্ত্রের ভোটাধিকার, সাম্য ও মানবিক বাংলাদেশ তার পথ হারিয়েছে। সেই ২০০৬ সালের ২৮ শে অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৮ বছরের ইতিহাস ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের কালো যুগ। সেই যুগে আমাদের কোন গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না, ভোটাধিকার ছিল না, অর্থনৈতিক অধিকার ছিল না, বিচারিক আদালতে মানুষের প্রতি কোন সু-বিচার ছিল না। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে আমাদের ঐতিহ্য ও জাতিসত্ত্বা এবং ইসলামী মুল্যবোধকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
সাবেক এমপি বলেন, আমাদের এই দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এই ৩টা জাতীয় ভোট বাংলা মানুষ দিতে পারে নাই। এ সময় তিনি উপস্থিত নেতা-কর্মীদেরকে বলেন, আপনারা কি ভোট দিতে পেরেছেন। তখন সকলেই সমস্বরে বলেন না। সকাল বেলা বাড়ী থেকে বের হয়ে ভোট দেয়ার জন্য কিছুদূর গেলেই আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশলীগ বাঁধা দিয়ে বলেছে ভোট হয়ে গেছে, আপনারা বাড়ী চলে যান। আমরা ভোট দিতে পারি নাই। যদিও বা কেউ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে চেষ্টা করেছে ৮-৯টার সময় প্রিজাইডিং অফিসাররা বলেছে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে, ভোট দেয়া যাবে না। এটা কোন ভোটাধিকার হলো।
গোলাম পরওয়ার বলেন, আমি সংসদ সদস্য ছিলাম। ২০১৮ সালে জামায়াতে ইসলামী আমাকে আবার মনোনিত করল। আমার বাড়ীর সামনের কেন্দ্রে ভোট দেয়ার জন্য গিয়েছিলাম। পথিমধ্যে সন্ত্রাসীরা আমাকে বলেছ আপনি ভোট দিতে আসবেন না। ভোট দিতে আসলে অসুবিধা আছে। শুধু আমাকে নয়, আমার বয়স্ক বাবাকেও পর্যন্ত ভোট দিতে দেয়নি। এই ছিল ১৪, ১৮ ও ২৪’র ভোটাধিকার। বাংলাদেশে এমন ভোট আর হতে দেয়া হবে না।
প্রধান অতিথি বলেন, স্বৈরাচারি, খুনি হাসিনা দাম্ভিকতা নিয়ে আমাদের নিরপরাধ নেতাদের মিথ্যা মামলা, মিথ্যা স্বাক্ষী সাজিয়ে, মিথ্যা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে অনেককে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে। এই ঘটনায় আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছে, কিন্তু আল্লাহ উপর ভরসা রেখে দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আমরা পিছুটান হয়নি। যার জন্যই আজ আমরা মুক্ত বাতাসে। আর হাসিনা যেখানকারর মাল সেখানেই চলে গেছে। সেখানেই গিয়েও তার শান্তি নাই। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকেন তিনি। হাসিনার বিরুদ্ধে ২২৬টি মামলা হয়েছে। খুনের মামলা, গণহত্যার মামলা হয়েছে। রেড এলার্ট জারি হয়েছে, ইন্টারপোলে ওয়ারেন্ট হয়েছে। রেহাই নাই তার। ৩শত এমপি, মন্ত্রীদের এখন খুঁজে পওয়া যায় না। জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দিতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু তার ফাঁসি দিতে কোন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া লাগবে না। সত্য ঘটনা দিয়ে তার কাম সাড়া যাবে। হাসিনার গঠিত ট্রাইব্যুনালেই তার বিচার হবে ইনশাআল্লাহ।
ভোলাবাসীর দাবী-দাওয়ার বিষয়ে গোলাম পরওয়ার বলেন, যে ভোলায় গ্যাস উৎপাদন হয়, সেই ভোলার মানুষ গ্যাস পাবে না এটা হতে পারে না। আপনাদের দাবীগুলো নিয়ে যাচ্ছি, অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আপনাদের দাবীগুলো উত্থাপন করা হবে। গ্যাস ডিষ্ট্রিবিউশন কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে বলেন, আগে ভোলাবাসীকে গ্যাস দেন, তারপরে দেশের অন্য স্থানে নেন।
তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সেতু ভোলা-বরিশাল সেতু। যে সেতু একনেকে পাশ হয়ে গেছে, তা কিভাবে বাতিল করা হয় ? আগামীতে বাংলাদেশে কোন বড় সেতু বাস্তবায়ন হলে সবার আগে ভোলা-বরিশাল সেতু বাস্তবায়ন করতে হবে। মেডিকেল কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন ভোলায় হবে না ? ভোলায় এত বড় বড় নেতা, মন্ত্রী ছিলেন; কিন্তু তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ আনতে পারেন নাই এটা দুঃখজনক। অবিলম্বে ভোলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডেকিলে কলেজ দিতে হবে।
ভোরার লঞ্চ টার্মিনালগুলো আধুনিকিকায়ন করা হবে। কারণ এই জেলার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্য হলো লঞ্চ। তাই এই টার্মিনালগুলোকে মর্ডারাইজ করতে হবে। এছাড়া ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরাকে জাতীয় গ্রীডের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ভোলাবাসীর দাবীগুলোর সাথে আছে। প্রধান উপদেষ্টার সাথে যখন কথা বলার সুযোগ হবে তখন আপনাদের দাবীগুলো তুলে ধরা হবে।
এদিকে কর্মী সম্মেলনকে সফল করতে কাক ডাকা ভোরে ঘন কুয়াশা উপপেক্ষা করেই ভোলার ৭ উপজেলা থেকে হাজার হাজার নেতা-কর্মী শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে ভোলা সরকারী স্কুল মাঠে আসতে থাকে। শুধু উপজেলা থেকে নয়, ভোলা সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন থেকে নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে মাঠে জড়ো হন। এক পর্যায়ে পুরো মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। মাঠেও জায়না না হওয়ায় নেতা-কর্মীরা সরকারী স্কুলের মাঠের পূর্ব ও উত্তর দিকের রাস্তায় অবস্থান নেন। জামায়াত-শিবিরের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী দ্বারা পুরো মাঠ নিয়ন্ত্রিত ছিল। ভোলার ইতিহাসে এই প্রথম জামায়াতে ইসলামীর এত বড় ঐতিহাসিক সম্মেলনে মানুষ দেখে নাই। সমাবেশে অন্তত লক্ষাধিক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। আজকের এই ঐতিহাসিক সম্মেলন ভোলায় ইসলামী আন্দোলনের একটি অংশ হয়ে থাকবে।
জেলা আমির মাষ্টার জাকির হোসাইনের সভাপতিত্বে এবং জেলা সেক্রেটারি হারুন-অর-রশীদের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি এডভোকেট মোয়ায্যম হোসেন হোসাইন হেলাল, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য ও বরিশাল মহানগরীর আমীর অধ্যক্ষ মোঃ জহির উদ্দিন বাবর, কেন্দ্রীয় মসলিশে শুরা সদস্য ও সাবেক কেন্দ্রীয় শিবির সভাপতি আবু জাফর মোঃ ওবায়েদুল্লাহ। এ ছাড়া আরো বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় মসলিশে শুরা ও বরিশাল অঞ্চলের টিম সদস্য এ, কে, এম ফখরুদ্দিন খান রাযী, ভোলা জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মোস্তফা কামাল, সাবেক আমীর মাওলানা ফজলুল করিম, ভোলা জেলা জামায়তে ইসলামীর নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মোঃ পারভেজ হোসেন, ভোলা সদর উপজেলার আমির মাওলানা কামাল হোসেন, জুলাই আগষ্টে গুলিবিদ্ধ ছাত্রনেতা মোঃ মাহমুদুল হাসান রাসেল, জেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রমূখ।