গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একের পর এক বেড়িয়ে আসছে মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির ওসি মহিদুলের নানা অপকর্মের চিত্র। সম্প্রতি কোনো অদৃশ্য খুটির জোরে প্রত্যাহার ঠেকিয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনিসহ তার টিম। এবার তার নেতৃত্বে পোশাক কর্মী স্ত্রীকে পুলিশ ফাঁড়িতে প্রায় ৩৩ ঘন্টা আটকে তার চালক স্বামীকে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এর বিচার চেয়ে পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামী-স্ত্রীকে নানা হুমকি দিচ্ছেন ওই ওসি ও তার টিম।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ বছর আগে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি থানার নুরুদ্দিনের ছেলে সবুজ সরকার জীবিকার খোঁজে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আসেন। পরে তিনি প্রেমের সর্ম্পকের জেরে ধনবাড়ি থানার চাটাভাঙ্গা এলাকার শহিদুল ইসলামের মেয়ে সেলিনা বেগমকে বিয়ে করেন। এরপর তারা কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে আসছেন। সর্বশেষ সফিপুর আন্দারমানিক এলাকার কলি বেগমের বাসায় ভাড়া থেকে স্বামী যমুনা কোম্পানিতে কর্ভাভ্যান চালক ও স্ত্রী স্থানীয় পোশাক কারখানায় কাজ করে আসছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে ইতি খানম সঙ্গে ২য় বিয়েতে আবদ্ধ হন স্বামী সবুজ। পারিবারিক কলহের জেরে ২য় স্ত্রী ইতি তার স্বামী সবুজকে তালাক দেন। কিন্ত ওই তালাকের প্রায় ১ মাস পর দেনমোহরের ৫০ হাজার টাকা তুলতে কালিয়াকৈর থানাধীন মৌচাক ফাঁড়িতে যান তালাকপ্রাপ্ত ইতি। ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ (ওসি) মহিদুল ইসলামের নির্দেশে এএসআই হাবিবুর রহমান হাবিব ফোনে তার তালাকপ্রাপ্ত স্বামী সবুজকে ডেকে পাঠায়। পুলিশের ফোন পেয়ে গত ১০ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে ওই ফাঁড়িতে যান সবুজ। তারপর
পুলিশ তার কাছে ২ লক্ষ টাকা দাবী করে। এতো টাকা দিতে অনিহা প্রকাশ করায় পুলিশ বিষয়টি তার ১ম স্ত্রী সেলিনাকে জানালে তিনি ৫০হাজার টাকা নিয়ে ওই ফাঁড়িতে যান। দাবীর চেয়ে ঘুষের টাকা কম দেয়ায় ওসি মহিদুল, এএসআই হাবিবুরসহ তিন পুলিশ মিলে তাকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে স্ত্রীর সামনে তাকে অমানবিক নির্যাতন করে। এসময় মারধর থামাতে আরো ১০হাজার টাকা পুলিশ দাবী করলে তার স্ত্রী আরো ৫ হাজার টাকা ব্যবস্থা করে দেয়। তারপরও শান্ত হয়নি ওসি মহিদুল ও তার টিম। দাবীকৃত ঘুষের টাকা না পেয়ে প্রায় ৩৩ ঘন্টা আটকে রেখে গত ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাদের স্বামী-স্ত্রীকে কালিয়াকৈর থানায় হস্তান্তর করে ফাঁড়ি পুলিশ।
তালাকপ্রাপ্ত ২য় স্ত্রী ইতি মামলা করতে অস্বীকার করলে ফাঁড়ি পুলিশ ১১ ডিসেম্বর রাতেই তার বড় বোন হাফিজা বেগমকে বাদী বানিয়ে একটি ধর্ষণ মামলা করে। ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৬ নভেম্বর সবুজকে তালাক দেন তার ২য় স্ত্রী ইতি। তালাকের পর প্রলোভন দেখিয়ে ৭ নভেম্বর থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় একাধিকবার ধর্ষক করে তালাকপ্রাপ্ত সবুজ। বাদী পক্ষের অভিযোগ, মামলায় উল্লেখিত সর্বশেষ ধর্ষণের পর প্রায় ১৬ দিন পর গত ১১ ডিসেম্বর কালিয়াকৈর থানায় মামলাটি দায়ের করেন ধর্ষিতার বড় বোন হাফিজা। কিন্তু ধর্ষিতার মেডিকেল পরিক্ষা করানো হয়নি। কিন্তু ওই মামলা দায়ের করা হলে পরের দিন
গত ১২ডিসেম্বর সবুজকে গাজীপুর জেলহাজতে প্রেরণ করে পুলিশ। ৪৩ দিন জেল খাটার পর গত ২২ জানুয়ারী আপোষনামার মাধ্যমে জামিনে বেড়িয়ে আসেন সবুজ। জামিনে বেড়িয়ে তিনি নিজের কর্মস্থলে গিয়ে দেখেন তার চাকুরী নাই। ফাঁড়ি পুলিশের এমন অমানবিক নির্যাতনের বিচার চেয়ে ওইদিনই ভুক্তভোগী সবুজ সরকারের ১ম স্ত্রী সেলিনা বেগম বাদী হয়ে গাজীপুর পুলিশ সুপার (এসপি) বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের বিষয়টি জানতে পেরে ওই মৌচাক ফাঁড়ি পুলিশ ও তাদের সমর্থিত লোক দিয়ে বাদী ও তার পরিবারকে নানা ধরণের ভয়ভীতিসহ হুমকি দিচ্ছেন। এমন কি আরো মামলা দিয়ে হয়রানির হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনাটি অস্বীকার করেন অভিযুক্ত ওই ওসি মহিদুল ইসলাম ও এএসআই হাবিবুর রহমান। ধর্ষণ মামলায় সবুজকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠালেও ওই আসামীকে চিনেন না বলেও জানান ওই পুলিশ সদস্যরা।
অপরদিকে শুধু সবুজ ও তার স্ত্রী সেলিনা নির্যাতনই নয়, গত ৫ জুলাইয়ের পর জুটের দাম কমানোর কথা বলে দেলোয়ার হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় ওই ওসি মহিদুল। এ ঘটনায় বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেকটনিক্স ও অনলাইন ভার্ষনে সংবাদ প্রচার হলে ১২ নভেম্বর ওই ওসিকে প্রত্যাহার করে রেঞ্জ অফিসে সংযুক্ত করা করা হয়। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে সেটা ঠেকিয়ে মৌচাক ফাঁড়িতেই থাকেন ওসি মহিদুল। এরপর যেন তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তিনি ও তার টিমের হাত থেকে রক্ষার দাবী জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারের মানুষেরা।
এদিকে জেল থেকে জামিনে বেড়িয়ে মৌচাক পুলিশ ফাঁড়িতে অমানবিক নির্যাতনের লোমহুষক বর্ণনা দিলেন সবুজ সরকার। তিনি বলেন, ফোন করে ফাঁড়িতে ডেকে নিয়ে পুলিশ আমাকে বলতেছে যে, তোমার নামে অভিযোগ হয়েছে। এখন তুমি কি করবা? স্যার কি অভিযোগ জানতে চাইলেই পুলিশ বলছে, আমি নাকি মাদক ব্যবসীয়, নারী পাঁচারকারী আর ধর্ষণকারী? আমার নামে নাকি তিনটি মার্ডার মামলাও আছে? পরে বললাম স্যার, আমার জীবনে মামলা-মুকাদ্দমা কি? আমি বুঝি না। আমি সাধারন একজন গাড়ির ড্রাইভার। আমার নামে মামলা থাকলে ফাঁড়িতে আসতাম না।
ওই সময় মহিদুল স্যার ও হাবিব স্যার মিমাংসার জন্য আমারে ২ লক্ষ টাকা দিতে বলেন। আমি বললাম, আমি গরীব মানুষ সাধারন একজন ড্রাইভার এতো টাকা কনে থেকে দিমু। পরে মা-বাবাসহ আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে গাড়ে ধরে ফাঁড়ির গাড়দে ভরে দেয়। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অমানষিক নির্যাতন করছে ফাঁড়ি পুলিশেরা। আমার শরীরের গিড়ায় গিড়ায় মারধর করেছেন তারা। পুলিশ কি আমাকে রিমান্ডে নিয়ে আইছিল? এমন প্রশ্ন ছুড়ে ওই নির্যাতনের শিকার সবুজ বলেন, বাংলাদেশের কোনো সংবিধানে আছে? ফোন করে ডেকে নিয়ে এভাবে নির্যাতন করা? আমাকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে পিটাইছে তিন পুলিশ। একজন ডান পাশ ও আরেকজন বাম পাশ মারে আর মহিদুল স্যার সামনে থেকে আমাকে লাথি মারতে থাকে। পরে আমার ১ম স্ত্রী সেলিনাকে জানালে সে ধারদেনা করে ৫০হাজার টাকা নিয়ে এএসআই হাবিবের হাতে দেয়। কিন্তু দাবী মতো টাকা না পেয়ে পুলিশ আমারে আরো কুত্তার মতো মারধর করে। টাকা আনবি না ক্যান? টাকা না নিয়ে এলে
তোরে মাইরা গুম করে ফেলবো। আসলে টাকার জন্যই আমারে এতো মারে। ম্যার ফেরানোর জন্য পুলিশ আরো ১০হাজার টাকা দাবী করলে আমার ১ম স্ত্রী আরো ৫হাজার টাকা ব্যবস্থা করে পুলিশকে দেয়। এরপর আমাকে ও আমার ১ম স্ত্রীকে সারারাত গাড়দে আটকে রাখে। এমন কি আমি জীবিত থাকতে আমার সামনে আমার স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দেয় পুলিশ। পুলিশেরা বলে মহিদুল স্যারকে সেবা যতœ করলে আমাগো ছাইড়া দিবো? তাহলে আমি জীবত কেন? এর থেকে আমার মইরা যাওয়াই ভালো! পরের পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই ফাঁড়ি থেকে আমারে ও আমার স্ত্রীকে কালিয়াকৈর থানায় পাঠায়। স্ত্রীর নামে অভিযোগ না থাকায় তাকে থানা থেকে ছেড়ে দেয়। আর আমাকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। এরপর ৪৩দিন জেল খেটে এসে দেখি আমার চাকরিটাও নেই। আমি এখন কিভাবে চলবো? পুলিশ সুপার স্যারের কাছে এসব নষ্ট পুলিশের নামে বিচার দেওয়ায় আমাদের হুমকি দিচ্ছে ওরা।
ভয়ে বাড়িতেও থাকতে পারছি না। একই বর্ণনা দিয়েছেন তার ১ম স্ত্রী সেলিনা বেগমও। এসময় অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে এর সুষ্ঠ বিচার চান পরিবারটি। অভিযুক্ত মৌচাক ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ (ওসি) মহিদুল ইসলাম জানান, এরকম কোনো ঘটনা আমার ফাঁড়িতে ঘটেনি। যদি ফাঁড়ির কেউ এমন ঘটনা ঘটায়, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর আমাদের কেউ ওই পরিবারকে হুমকি দেয়নি। এছাড়া মিথ্যা নিউজে আমার বদলি হয়েছিল। বদলি ঠেকায়নি সেটা তদন্তের পর সত্যতা না পাওয়ায় কোনো সমস্যা হয়নি।
এব্যাপারে গাজীপুর পুলিশ সুপার (এসপি) ড. চৌধুরী মোঃ যাবের সাদেক জানান, ওই নারীর অভিযোগটি পেয়েছি। এ বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগে সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।