কুড়িগ্রামের উলিপুরে তিস্তার বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চলের কৃষিপণ্য পরিবহনে একমাত্র
ঘোড়ার গাড়ি অনন্য ভূমিকা রাখছে। এক সময়ে এসব চরাঞ্চলে দাপুটের সাথে
মহিষের গাড়ি দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হত। সময়ের বিবর্তনে সেই মহিষের গাড়িও
আজ হারিয়ে গেছে আর সেই চরাঞ্চলের পণ্য পরিবহনে এখন ব্যবহার হচ্ছে ঘোড়ার
গাড়ি। তিস্তায় শুকনা মৌসুমে পানি না থাকায় বিশাল এলাকা জুরে শুধু বালুচর।
তিস্তার সেই বালুচরের কৃষকরা এখন পাম্প বসিয়ে গম, ভূট্টা, আলু, বাদাম, মিষ্টি
কুমড়া, মরিচসহ নানা জাতের সবজি উৎপন্ন করে থাকে। এক সময়ের মহিষের
গাড়ি হারিয়ে যাওয়ায় এসব কৃষিপণ্য পরিবহনে কৃষকদের অনেক ঝামেলা
পোহাতে হত। এ এলাকার অনেকেই ইদানিং ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করায় কৃষকদের
মাঝে স্বস্তি এসেছে। রাস্তাঘাট না থাকায় অধিকাংশ ঘোড়ার গাড়ি চালকরা
জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছুটে চলে, এক চর থেকে অন্য চরে। ফলে চরের উৎপাদিত
কৃষিপণ্য লোকালয়ে কিংবা কাছাকাছি ছোট বাজারগুলোতে আনা-নেয়ার জন্য
অবদান রাখছে ঘোড়ার গাড়ি।
উপজেলার দলদলিয়া, থেতরাই, গুনাইগাছ ও বজরা মিলে ৪টি ইউনিয়নের সিংহভাগ
এলাকা তিস্তা নদী দ্বারা বেষ্টিত। শুকনো মৌসুমে দলদলিয়া ইউনিয়নের কর্পূরা,
কদমতলা, অর্জুন, রামনিয়াশা, থেতরাইয়ের গোড়াই পিয়ার, দড়ি-কিশোরপুর, মধ্য
গোড়াই, গুনাইগাছের হোকডাঙ্গা, নাগড়াকুড়া, টিটমা, সন্তোষ অভিরাম, বজরার
বিরহিম, সাতালস্কর, সাদুয়া দামারহাটাসহ অসংখ্য চরের হাজারো মানুষের একমাত্র
যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে এসব ঘোড়ার গাড়ি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের খরস্রোতা
তিস্তাসহ নানান নদ-নদী। শুকনো মৌসুমে তাকালেই চোখে পড়ে শুধুই বালুচর।
জীবন ও জীবিকা রক্ষায় চরের মানুষ এসব ঘোড়াগাড়ির উদ্ভাবন করেছে। ফলে
মানুষের দুর্ভোগ অনেক কমেছে। চরাঞ্চলে যান্ত্রিক যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল
করতে না পারায় মানুষ প্রচন্ড গরমের উত্তপ্ত বালুতে পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিত
এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্যগুলো মাথায় কিংবা ঘাড়ে নিয়ে বহন করতো।
বর্তমানে ঘোড়ার গাড়ি চালু হওয়ার পর চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয়
মালামাল পরিবহনসহ ব্যবসায়ীদের পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য একমাত্র মাধ্যম হিসেবে
গাড়িটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ভূমিকা রাখছে। সেইসাথে প্রত্যন্ত চর
এলাকার অনেক মানুষই এখন ঘোড়ার গাড়ি দিয়েই তাদের জীবিকা নির্বাহ
করছেন।
সাতালস্করের আবুল, জমশেদ, আউয়ালসহ অনেকেই বলেন, তিস্তার চরাঞ্চালে শুকনো
মৌসুমে নদীতে পানি কমে যায় এবং বিশাল এলাকাজুড়ে চর জেগে উঠে। চরে
যাতায়াতের জন্য যান্ত্রিক গাড়ি, ভ্যান, রিকশা, অটো, মাইক্রো চলাচল একেবারেই
অসম্ভব। তাই এই এলাকার যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি ব্যাপক
ব্যবহার হচ্ছে। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট না থাকায় এখানে যান্ত্রিক গাড়ি না চলায়
চরবাসীকে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। এসব সমস্যাকে উপেক্ষা করে তাদের নিত্য দিনের
কাজ পরিচালনার জন্য তারা ব্যবহার করে অযান্ত্রিক ও পরিবেশবান্ধব ঘোড়ার গাড়ি।
এই গাড়ি কৃষকদের পণ্য পরিবহণ, অসুস্থ মানুষদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
নিয়ে যাওয়ার জন্য তীরে পৌঁছে দেওয়া, চরাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য এক
জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া এবং চরবাসীর অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের
একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
উপজেলার গোড়াইপিয়ার চরাঞ্চলের ঘোড়া গাড়ি চালক রুহুল আমীন বলেন, তিস্তার
চরাঞ্চলে সবসময় বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ হয়েই থাকে। বর্তমান আলুর চাষ হয়েছে।
বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে বস্তা প্রতি ৩০ টাকা দরে ঘাট পাড়ে
পৌঁছে দেই। এভাবে দিনে প্রায় ৫০ বস্তা পর্যন্ত ঘাট পাড়ে নিয়ে আসা যায়।
তাতে প্রতিদিন আয় হয় ১ হাজার থেকে ১৫’শ টাকা। ঘোড়ার খাদ্যে প্রতিদিন
খরচ হয় ২শ ৫০ টাকা। বাকি টাকা দিয়ে আমার সংসার ভালোই চলে।
ঘোড়ার গাড়ি চালক মধু মিয়া, কুদ্দুস, লাল মিয়া ও আসাদুল ইসলামসহ আরও
অনেকে বলেন, তিস্তার চরে শুকনো মৌসুমে ৪-৫ মাস ভালই চলে ঘোড়ার গাড়ি
দিয়ে পণ্য পবিহনের কাজ। মে মাসের মাঝামাঝি তিস্তা নদীতে পানি এলে বন্ধ হয়ে
যায় ঘোড়ার গাড়ি। তখন থেকে তারা আবার অপেক্ষায় থাকে কবে তিস্তা নদী শুকিয়ে
যাবে। অবশ্য ঘোড়ার গাড়ির মালিকরা ৫/৬ মাসেই পুরো বছরের ইনকাম করে থাকে।
উপজেলার তিস্তার চরের বড় আলু চাষি বিদেশী আবুল জানায়, আমার ২০ একর
জমিতে চাষ করা ৩ হাজার ৪’শ বস্তা আলু এক মাত্র ঘোড়ার গাড়ি করে ঘাটে নিয়ে
এসেছি। ঘোড়ার গাড়ি পরিবহণ খরচ বস্তা প্রতি ৩০ টাকা করে দিয়েছি।
উপজেলার তিস্তা পাড়ের পানিয়ালের ঘাটের মালিক সোহরাওয়ার্দী জানান, এখন
তিস্তা নদীতে পানি অনেক কম। চর ভেসে উঠেছে যেখানে বালু আর বালু। এই
চরাঞ্চলে কৃষি পণ্য বহন করার জন্য এক মাত্র উপায় ঘোড়ার গাড়ি। নদীতে পানি
এসে যখন নদী জীবন ফিরে পায় তখন নৌকা দিয়ে পারাপার করা হয়। এখন বিভিন্ন
চরাঞ্চল থেকে কৃষি পণ্য ঘোড়ার গাড়িতে নিয়ে এপার থেকে ওপারে নিয়ে আসা
যাওয়া করছেন। যখন তিস্তায় পানি কমে যায় সামান্য পানির উপর দিয়ে ঘোড়ার
গাড়ি দিয়েই মালামাল পার করা হয় বলে জানান তিনি।