বনবিভাগের উদ্যোগে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ঈদের আগের দিন হঠাৎ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। ঈদ ফিতরের সকল প্রস্তুতির মালামালসহ দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে তছনছ করে বনবিভাগ। ফলে গত তিন দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপ করছেন শিশু, গর্ভবর্তী নারী, বৃদ্ধসহ ক্ষতিগ্রস্থ শত শত পরিবারের মানুষের। হঠাৎ এমন উচ্ছেদে তাদের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে রূপ নিয়েছে বিষাদে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার আহাজারী ছাড়াও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নানা মহলের মানুষ।
সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক মাস সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। উদ্ধসঢ়;যাপিত হবে দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খাওয়া-দাওয়া, নতুন জামাকাপড় আর ঘুরাঘুরি। তাই শিশু থেকে বয়স্ক সবাই ঈদের আনন্দ বরণ নিতে উদ্ধসঢ়;গ্রীব। রমজানের শেষ দিন সকল প্রস্তুতি নিয়ে সবার মনে যখন ঈদ আনন্দ, ঠিক তখনই যেন মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল হঠাৎ ঢাকা বনবিভাগের উচ্ছেদ অভিযান। গত রোববার দিনব্যাপী উপজেলার চন্দ্রা রেঞ্জের সিনাবহ ও বাঘাম্বর এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চলে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বশিরুল আল মামুন, ঢাকা বিভাগের এসিএফ ফাহিম মাসুদ, স্থানীয় রেঞ্জের বিভিন্ন অফিসের রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এছাড়াও অভিযানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আনসার বাহিনী এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। বন বিভাগ ও এলাকাবাসীর দাবী, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বনবিভাগের জমি জবর-দখল করে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধু ৫ আগস্ট নয়, সব সময়ই বনের জমি জবর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে।
আর স্থানীয় দালালচক্র ও বনের অসাধু কর্মকর্তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের সহযোগিতা নিয়েই জবর-দখলের মাধ্যমে এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে আসছে দখলদাররা। এছাড়াও বনের জমি জবর-দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো। তবে ৫ আগস্টের পর চন্দ্রা রেঞ্জের চন্দ্রা বিট আফিসের আওতায় সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্থাপনা তৈরি হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই দোতলা ভবন, কেউ টিনশেড, আবার কেউ আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেছেন।
বনের জমি জবর-দখলের মহাউৎসবে ঘর নির্মাণ করে বাসা ভাড়া দিয়েছেন স্থানীয় অসাধু ব্যক্তিরাও। গত শনিবার এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে সরিয়ে নেওয়ার জন্য মাইকিং করে বনবিভাগ। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেননি। অবশেষে ঈদের আগের দিন রোববার দিনব্যাপী যৌথ বাহিনীর সহযোগিতায় ৪টি এক্সকাভেটর দিয়ে সিনাবহ ও বাঘাম্বর এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বনবিভাগ।
অভিযানকালে স্থানীয় লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এক পর্যায়ে বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে বনবিভাগের লোকজনসহ উভয়পক্ষে ১০/১২ জন আহত হয়েছেন। ঈদের আগের দিন হঠাৎ এমন উচ্ছেদ অভিযানে ঈদ ফিতরের সকল প্রস্তুতির মালামালসহ দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে তছনছ করে দেয় বনবিভাগ।
ফলে গত তিন দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিশু, গর্ভবর্তী নারী, বৃদ্ধসহ ক্ষতিগ্রস্থ শত শত পরিবারের মানুষ। এরা বেশির ভাগ পোশাক শ্রমিক ও নদী ভাঙ্গা এলাকার মানুষ। হঠাৎ এমন উচ্ছেদে তাদের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে রূপ নিয়েছে বিষাদে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার আহাজারী ছাড়াও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নানা মহলের মানুষ। তাদের প্রশ্ন শুধু অসহায়দের কেন? বনের জমিতে গড়ে উঠা প্রভাবশালীদের বহুতল ভবন, বিভিন্ন শিল্পকারখানা, বিনোদন কেন্দ্র সোহাগ পল্লী, শিল্প কুঞ্জ, রাঙামাটি রির্সোটে কবে উচ্ছেদ করা হবে? অপরদিকে খবর পেয়ে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা সেখানে পরিদর্শনে গেলেও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন কালিয়াকৈর পৌর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইজুদ্দিন আহমেদ। তিনি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মাঝে ঈদ উপহার ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। ওই নেতা বলেন, যে পরিমান ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছে, আশা করছি আগামী ১৫-১৬ দিন তারা ভালভাবে কাটিয়ে দিতে পারবেন। প্রয়োজনে আরো সহায়তা দেওয়া হবে।
ক্ষতিগ্রস্থ আবুল কালাম বলেন, যারা নতুন ঘর নির্মাণ করেছেন, তাদের ঘর ভেঙ্গে দেওয়া হোক। কিন্তু আমরা ১০ থেকে ১২ বছর আগে যে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করে আসছি, সেই ঘরও ভেঙ্গে দিয়েছে। ঈদের আগে দিন আগে হঠাৎ ঘর ভেঙ্গে দেওয়ায় এখন আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আব্দুল জলিল(৭৫) বলেন, আমার জমির কাগজপত্র সব সঠিক থাকলেও তারা আমার কাগজ দেখেনি। উল্টো লাঠি দিয়ে আঘাত করে আমার হাতসহ বাড়িঘরও ভেঙ্গে দিয়েছে। মাহমুদা বেগম বলেন, ঈদের একটা দিন গেল।
আমাদের রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া নেই। কেউ কিছু দিলে খাচ্ছি। খোলা আকাশের নিচে থাকছি। রাতে ঘুমায় না জেগে থাকি, কখন যেন শিয়াল-কুকুরে শিশু বাচ্চাটার ক্ষতি করে। পান্না আক্তার বলেন, ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারি নাই। টাকা, গহনা গেল কই? নার্গিস বেগম বলেন, স্বামী ক্যান্সার রোগী। পাচ সন্তানের মধ্যে ২ মেয়ে প্রতিবন্ধী। এখানে বিদ্যুৎ, পানি, টয়লেট ব্যবস্থা নেই কিভাবে থাকি? আসমা বেগম বলেন, ঘরবাড়ি করার সময় বন বিভাগের লোকদের টাকা দিয়েছি। এখন হঠাৎ ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে ঈদের আনন্দ কেড়ে নিলো।
এ ব্যাপারে এসিএফ ও কালিয়াকৈর চন্দ্রা রেঞ্জ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শহিদুল ইসলাম শাকিল জানান, সরকারের নির্দেশক্রমে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকালে বনবিভাগের লোকজন কেন টাকা নিয়েছেন এমন প্রশ্ন করলে ক্ষেপে গিয়ে তিনি বলেন, আমি তো টাকা নেয়নি। এছাড়াও আমাদের উপর হামলার ঘটনায় থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে বনভূমি পুনরুদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে।