Dhaka ০৩:০৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিল কুমারী বিলের প্রাণবৈচিত্র নিয়ে উৎসব

????????????

রাজশাহীর তানোরের বিলজোয়ানা ও বিলকুমারী বিল দুটি প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। সম্প্রতি সরকার বিলজোয়ানাকে বাংলাদেশের প্রথম ‘জলাভূমিনির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করেছে। ২২ মে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে গত বুধবার বিলের ধারে উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে শিশুদের জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, মাছ ধরার উপকরণ চেনানো হয়। ছিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভা।

তানোর উপজেলার গোকুল-মথুরা গ্রামের বিলপাড়ে বারসিক (বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ), সবুজ সংহতি ও গোকুল-মথুরা যুব সংগঠন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আয়োজকেরা বলছেন, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণপ্রাচুর্যময় অঞ্চল হলো তানোরের বিলজোয়ানা-বিলকুমারী। বিল দুটির একত্রে আয়তন প্রায় ৩৮৭ একর। বিলের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শিব নদ। এই বিলাঞ্চল শুধু মাছ বা পাখির আবাস নয়, বরং হাজারো প্রাণবৈচিত্র্যে এক সমৃদ্ধ কেন্দ্র। প্রতিবছর বর্ষাকালে বিলগুলো পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং শুষ্ক মৌসুমে কিছু অংশ হয়ে ওঠে কৃষিকাজের মাঠ। এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশু পালন এবং স্থানীয় জীবনযাত্রা সরাসরি এই বিলভিত্তিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।

অতীতের প্রাণপ্রাচুর্যময় বিলজোয়ানা-বিলকুমারীর জৌলুস দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। বিলকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন-জীবিকা এবং একই সঙ্গে জলজ প্রাণবৈচিত্র্য কমে যাওয়ার কারণে এখন নানাভাবে পরিবেশও হুমকিতে পড়েছে। বিলের চারপাশে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার, দখল-দূষণ, পাখি শিকারসহ নানা কার্যক্রমের কারণে জলাভূমিনির্ভর প্রাণবৈচিত্র্য কমে গেছে। অন্যদিকে বিলকে কেন্দ্র করে মৎসজীবীদের পেশাও সংকটের মুখে।উৎসবে অংশ নেন গোকুল-মথুরা গ্রামের কৃষক-জেলে, নারী, প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। আলোচনা পর্বে অনুষ্ঠানের অতিথি নদীগবেষক ও সবুজ সংহতি সংগঠনের আহ্বায়ক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘শিব নদে বাঁধ দেওয়ার ফলে বিলজোয়ানা-বিলকুমারী আস্তে আস্তে জলহীন হতে থাকে। যার ফলে বিলের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। অনেক জলজ প্রাণ বিলুপ্ত হয়েছে।’ তিনি বিলজোয়ানা-বিলকুমারী খনন করার দাবি জানান।

বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘সব প্রাণ সংরক্ষণ করেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ হলেই আমাদের প্রকৃতি সুরক্ষা হবে।’ এ বিষয়ে জনগোষ্ঠীর সচেতনতার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন।অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. শহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কর্মসূচি কর্মকর্তা অমৃত সরকার। গ্রামের স্বভাবকবি আফাজ উদ্দিন কবিরাজ বিলের বৈচিত্র্য নিয়ে কবিতা পাঠ করে শোনান। তিনি কবিতার মাধ্যমে বিলের প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেন।

বিলকুমারী বিলের প্রাণবৈচিত্র্য উৎসবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় গোকুল–মথুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষার্থী। ছবি এঁকে শ্রেণির কুমারী তিথি সূত্রধর প্রথম, সুরাইয়া খাতুন দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির মোহনা সরকার তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে।জলজ উদ্ভিদবৈচিত্র্য দিয়ে স্টল সাজিয়েছিলেন কবি আফাজ উদ্দিন কবিরাজ। তিনি কবিতার সুরে শিশুদের গাছের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। বিলজোয়ানা-বিলকুমারী রক্ষার বিভিন্ন স্লোগান লেখা রঙিন সব ফেস্টুনে সাজানো ছিল উৎসব প্রাঙ্গণ। সঙ্গে ছিল জেলে সম্প্রদায়ের মাছ ধরার বিভিন্ন দেশীয় উপকরণের স্টল, যা আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।বিলজোয়ানা-বিলকুমারী রক্ষায় গোকুল-মথুরা জেলে সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে জেলে সংগঠনের সভাপতি আতাউর রহমান পাঁচটি দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো শিব নদের বাঁধ অপসারণ করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা, বিল দখলমুক্ত করা ও বিলের জমি নির্ধারণ করে সীমানা পিলার দেওয়া, শিব নদ ও বিলজোয়না-বিলকুমারী খনন করে সারা বছর পানি সংরক্ষণ করা, বিলের প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করা এবং বিলে মাছের প্রজননের সময় যখন মাছ ধরা বন্ধ থাকবে তখন বিলনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি বরাদ্দ চালু করা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

কোস্টগার্ড অস্ত্র ও গোলাবারুদ ও সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর এক সহযোগীকে আটক

বিল কুমারী বিলের প্রাণবৈচিত্র নিয়ে উৎসব

Update Time : ০৪:১০:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

রাজশাহীর তানোরের বিলজোয়ানা ও বিলকুমারী বিল দুটি প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। সম্প্রতি সরকার বিলজোয়ানাকে বাংলাদেশের প্রথম ‘জলাভূমিনির্ভর প্রাণী অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করেছে। ২২ মে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে গত বুধবার বিলের ধারে উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে শিশুদের জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, মাছ ধরার উপকরণ চেনানো হয়। ছিল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভা।

তানোর উপজেলার গোকুল-মথুরা গ্রামের বিলপাড়ে বারসিক (বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ), সবুজ সংহতি ও গোকুল-মথুরা যুব সংগঠন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আয়োজকেরা বলছেন, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণপ্রাচুর্যময় অঞ্চল হলো তানোরের বিলজোয়ানা-বিলকুমারী। বিল দুটির একত্রে আয়তন প্রায় ৩৮৭ একর। বিলের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শিব নদ। এই বিলাঞ্চল শুধু মাছ বা পাখির আবাস নয়, বরং হাজারো প্রাণবৈচিত্র্যে এক সমৃদ্ধ কেন্দ্র। প্রতিবছর বর্ষাকালে বিলগুলো পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং শুষ্ক মৌসুমে কিছু অংশ হয়ে ওঠে কৃষিকাজের মাঠ। এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশু পালন এবং স্থানীয় জীবনযাত্রা সরাসরি এই বিলভিত্তিক বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।

অতীতের প্রাণপ্রাচুর্যময় বিলজোয়ানা-বিলকুমারীর জৌলুস দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। বিলকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন-জীবিকা এবং একই সঙ্গে জলজ প্রাণবৈচিত্র্য কমে যাওয়ার কারণে এখন নানাভাবে পরিবেশও হুমকিতে পড়েছে। বিলের চারপাশে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার, দখল-দূষণ, পাখি শিকারসহ নানা কার্যক্রমের কারণে জলাভূমিনির্ভর প্রাণবৈচিত্র্য কমে গেছে। অন্যদিকে বিলকে কেন্দ্র করে মৎসজীবীদের পেশাও সংকটের মুখে।উৎসবে অংশ নেন গোকুল-মথুরা গ্রামের কৃষক-জেলে, নারী, প্রবীণ ও নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। আলোচনা পর্বে অনুষ্ঠানের অতিথি নদীগবেষক ও সবুজ সংহতি সংগঠনের আহ্বায়ক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘শিব নদে বাঁধ দেওয়ার ফলে বিলজোয়ানা-বিলকুমারী আস্তে আস্তে জলহীন হতে থাকে। যার ফলে বিলের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। অনেক জলজ প্রাণ বিলুপ্ত হয়েছে।’ তিনি বিলজোয়ানা-বিলকুমারী খনন করার দাবি জানান।

বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘সব প্রাণ সংরক্ষণ করেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ হলেই আমাদের প্রকৃতি সুরক্ষা হবে।’ এ বিষয়ে জনগোষ্ঠীর সচেতনতার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন।অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী মো. শহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কর্মসূচি কর্মকর্তা অমৃত সরকার। গ্রামের স্বভাবকবি আফাজ উদ্দিন কবিরাজ বিলের বৈচিত্র্য নিয়ে কবিতা পাঠ করে শোনান। তিনি কবিতার মাধ্যমে বিলের প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেন।

বিলকুমারী বিলের প্রাণবৈচিত্র্য উৎসবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় গোকুল–মথুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষার্থী। ছবি এঁকে শ্রেণির কুমারী তিথি সূত্রধর প্রথম, সুরাইয়া খাতুন দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির মোহনা সরকার তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে।জলজ উদ্ভিদবৈচিত্র্য দিয়ে স্টল সাজিয়েছিলেন কবি আফাজ উদ্দিন কবিরাজ। তিনি কবিতার সুরে শিশুদের গাছের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। বিলজোয়ানা-বিলকুমারী রক্ষার বিভিন্ন স্লোগান লেখা রঙিন সব ফেস্টুনে সাজানো ছিল উৎসব প্রাঙ্গণ। সঙ্গে ছিল জেলে সম্প্রদায়ের মাছ ধরার বিভিন্ন দেশীয় উপকরণের স্টল, যা আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।বিলজোয়ানা-বিলকুমারী রক্ষায় গোকুল-মথুরা জেলে সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে জেলে সংগঠনের সভাপতি আতাউর রহমান পাঁচটি দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো শিব নদের বাঁধ অপসারণ করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা, বিল দখলমুক্ত করা ও বিলের জমি নির্ধারণ করে সীমানা পিলার দেওয়া, শিব নদ ও বিলজোয়না-বিলকুমারী খনন করে সারা বছর পানি সংরক্ষণ করা, বিলের প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করা এবং বিলে মাছের প্রজননের সময় যখন মাছ ধরা বন্ধ থাকবে তখন বিলনির্ভর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি বরাদ্দ চালু করা।