Dhaka ০৯:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এনআর‌বিসি ব‌্যাং‌ক ৬শ টাকার ড্রাফট‌কে ৬‌ কো‌টি টাকা দেখি‌য়ে‌ছে

ছাতক সিমেন্ট কারখানা যেন দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত এ কারখানার অভ্যন্তরীণ এসব অনিয়ম-দুর্নীতি চলছেই। একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভুয়া কাগজপত্রে ৬‌ কো‌টি টাকার ভুয়া ব্যাংক ড্রাফট জা‌লিয়া‌তির ক‌রে সবোচ্চ দরদাতা নিবা‌চিত হ‌য়ে‌ছেন। এ মহা জা‌লিয়া‌তি ও ভুয়া ব‌্যাংক ড্রাফেট সঙ্গে সি‌মেন্ট কারখানার একা‌ধিক কর্মকতা ও এনআর‌বিসি ব‌্যাং‌কের ম‌্যা‌নেজার জ‌ড়িত থাকার অ‌ভি‌যোগ উঠে‌ছে।  এ ঘটনায় সর্বত্র ব্যাপক সামা‌জিক যোগা‌যোগ ফেইসবু‌কের মাধ‌্যমে তোলপাড় ঝড় বইছে।

সিসিএল এর পুরাতন ওয়েট প্রসেস কারখানার অব্যবহৃত -অকেজো চিহ্নিত বিভিন্ন স্থাপনা সহ বিভিন্ন পয়েন্টের স্ক্যাপ মালামাল ১ (এক) লটে (যেখানে যে অবস্থায় আছে) তা বিক্রয়ের দরপত্র প্রকাশ করা হয়। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সিমেন্ট প্রস্তুতকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাতক সিমেন্ট কারখানায় সংঘটিত আবা‌রো ও  ব‌্যাং‌ক ড্রাফট জা‌লিয়া‌তি ও মহা দুর্নীতির একটি চিত্র ফুটে উঠেছে কারখানায়। গত ২৫ মে রোববার বিকা‌লে আবা‌রো ও সি‌মেন্ট কারখানায় এ দরপ‌ত্রে ব‌্যাং‌কের ভুয়া ড্রাফটের মহা জা‌লিয়া‌তির ঘটনা ঘ‌টে।

জানা যায়,ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পুরাতন প্রজেক্টের মালামাল,বিভিন্ন স্থাপনা,যেখানে যে অবস্থায় আছে স্ক্যাপ মালামাল বিক্রির টেন্ডার গত ১০  মার্চ  সিমেন্ট কারখানার টেন্ডার কমিটি, কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সন্মুখে টেন্ডার বক্স খোলা হয়। এ কাজে ৭১ টি দরপত্র বিক্রি হলেও জমা পড়েছেন  মাত্র ৩ টি দরপত্র। এই ৩ টি দরপত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হয়ে‌ছেন কিশোরগঞ্জ-ভৈরবের মেসার্স মমিনুল হক ৫৯ কোটি ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৬ শত ৬৫ টাকার। এ প্রতিষ্ঠান ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার জানানত দিয়ে ৪৮ কোটি টাকা দর দাখিল করেন। দ্বিতীয় হয়েছেন মেসার্স বিছমিল্লাহ ট্রেডার্স,সোনালী চেলা,এ প্রতিষ্ঠান ৪৬ কোটি টাকা দর দাখিল করেছি‌লেন। তৃতীয় দরদাতা হয়েছেন মেসার্স শরাফত এন্ড সন্স,নোয়ারাই বাজার, এ প্রতিষ্ঠান ২৪ কোটি টাকা দর দাখিল করেন।

ছাতক সিমেন্ট কোম্পানীর বিক্রয় পুনঃ দরপত্র আহবান করে‌ছেন গত ৫ মে। সর্বোচ্চ দরদাতা বিল্লাল এন্টারপ্রাইজের  ৬ শত টাকার  পে- অর্ডারকে এনআরবিসি ব‌্যাং‌কের ছাতক শাখার দুনী‌তিবাজ ম‌্যা‌নেজারকে ম‌্যা‌নেজ ক‌রে ছয় কো‌টি টাকা ভুয়া ড্রাফট তৈ‌রি কর‌ছেন। দরপত্রে অংশ গ্রহণকারী ৮ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন,বিল্লাল এন্টারপ্রাইজ ৭৫ কোটি ৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।

দ্বিতীয় দরদাতা নির্বাচিত হন বিছমিল্লাহ- সোনালী চেলা ইঞ্জিনিয়ারিং  ৭১ কোটি ১ লক্ষ টাকা। ৩ য় দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন মেসার্স রাকিব হাসান,তিনি দর দাখিল করেন ৬৯ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। ৪র্থ হলেন কর্ণফুলী রিভার্স ট্রান্সপোর্ট। তারা দর দাখিল করেন ৬৩ কোটি ১৬ লক্ষ ৫ শ ৫৫ টাকা। এছাড়া শহীদ ট্রেডার্স ৬১ কোটি টাকা,রাব্বি এন্টারপ্রাইজ ৫৯ কোটি,৯৫ লক্ষ ৯৯ হাজার টাকা,সালেহ এন্ড ব্রাদার্স ৫১ কোটি টাকা। মা আয়রণ পয়েন্ট ৪৯ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার দরপত্র  দাখিল করেছেন।

২০১৮ সা‌লে তিনি বিনা টেন্ডারে ৩৫ লাখ টাকায় কারখানার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিক্রি করেছিলেন। পরে এলাকাবাসীর প্রতিবাদের মুখে টেন্ডারের মাধ্যমে তা আড়াই কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। ২০১৮ সা‌লে এক বছরে ভারত থেকে আসা প্রতি টন ১৮শ’ টাকার চুনাপাথর খোলাবাজারে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে কারখানার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আলোচ্য এই কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেট। গভীর অনুসন্ধান চালানো হলে ছাতক সিমেন্ট কারখানার আরও অনেক দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে গড়ে উঠছে স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেট এবং সেই সিন্ডিকেট নানা কারসাজিতে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। এসব সিন্ডিকেটের চোখে প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কোনো মূল্য নেই। প্রয়োজনে তারা নিজেদের সামান্য স্বার্থের জন্য প্রতিষ্ঠানের বিশাল ক্ষতি করতেও প্রস্তুত। এ ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে- ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’। ছাতক সিমেন্ট কারখানা এ দেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেশের অবকাঠামো নির্মাণে এ শিল্পের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। ২০১৮ সা‌লে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সেখানে। কমিটি দুটি প্রভাবমুক্ত অবস্থায় নিরপেক্ষভাবে প্রতিবেদন উপস্থাপন কর‌তে পা‌রে‌নি। ২০১৭ সা‌লে ১৩ ডিসেম্বর ছাতক পূবালী ব্যাংকের দেয়া মাসিক হিসাব বিবরণীতে এ জালিয়াতির ঘটনায় কারখানার হিসাব কর্মকর্তা রেজাউল করিম ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করে। এতে জাল ক্রেডিট ভাউচার দিয়ে কারখানার ৯২ লাখ টাকার সিমেন্ট তোলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। জানা গেছে, সম্পা ও হানিফ এন্টারপ্রাইজের নামে ভুয়া ৭টি ভাউচারে ৯২ লাখ টাকা ছাতক পূবালী ব্যাংকে পেমেন্ট দেখানো হলেও এগুলো ছিল জাল। পরে কারখানা ও ব্যাংক হিসাবে গরমিলের জন্য এ ঘটনার ব্যাপারে অধিকতর তদন্তে ধরা পড়ে।

সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংক ঢাকার একটি শাখায় সম্পা ও হানিফ এন্টারপ্রাইজের দেয়া ২ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ভুয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে ধমক দিয়ে ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা পরিশোধের বিষয়টিও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেন জ‌নৈক প‌রিচালক। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে কারখানার  বিএমআরই প্রজেক্টের শীর্ষ কর্মকর্তা বাদশা,সা‌বেক এম‌পি মুহিবুর রহমান মা‌নিক,সা‌বেক সি‌বিএ শ্রমিকলী‌গের সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সহ সভাপ‌তি আব্দুল কদ্দছু সহ কারখানার হিসাব বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার সি‌ন্ডি‌কেট আছে। এ ঘটনায় ছাতক সিমেন্ট কারখানার হিসাব কর্মকর্তা আতিকুল ইসলামসহ ৪ জনকে শোকজ করা হয়েছে বলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেপাল কৃষ্ণ হাওলাদার জানান। এসব হাতিয়ে নেয়া ৯২ লাখ টাকার ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ হয়েছে বলেও দাবি করেন।  জানা গেছে, কেপিএম থেকে দুর্নীতির অভিযোগে বদলিকৃত জনৈক কর্মকর্তা কারখানার লুটপাটের মূল হোতা বলে স্থানীয়রা জানান। এ ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় ছাতক সিমেন্ট কারখানার রোপওয়ের বিভাগীয় প্রধান মাহবুব এলাকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বিসিআইসি।

এটিমের তদন্তে জালিয়াতিসহ লুটপাটের ঘটনায় জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে আবদুর রহমান বাদশার নাম চলে আসে। একটি সূত্র জানায়, প্রজেক্টের ডিপিডি আবদুর রহমান বাদশা কারখানার বড় ধরনের লুটপাট, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বিনা টেন্ডারে মাত্র ৩৫ লাখ টাকায় কারখানার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিক্রি করেছিল। পরে এলাকাবাসীর প্রতিবাদের মুখে টেন্ডার দিয়ে এটি আড়াই কোটি টাকা বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া গত ১ বছরে কারখানার নামে ভারত থেকে আসা প্রতি টন ১৮শ’ টাকার চুনাপাথর খোলাবাজারে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে কারখানার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বাদশাসহ একটি সিন্ডিকেট। এভাবে নতুন বিএমআরই প্রজেক্টের উত্তোলিত ১৩ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১ কোটি টাকার কাজ দেখিয়ে ১২ কোটি টাকা লাপাত্তা করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। এ ব্যাপারে ছাতক সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক ইউনিয়ন বি- ৮০ এর সভাপতি মোঃ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক শফি উদ্দিন এ ঘটনার সত‌্যতা নি‌শ্চিত ক‌রে ব‌লে এনআর‌সি ব‌্যাংক ড্রাফট ভুয়া ও জাল ব‌লে এম‌ডি তা‌দের‌কে জানান।

এব‌্যাপা‌রে এনআর‌বি‌সি ছাতক শাখার ম‌্যা‌নেজার সাকাতওয়াত হো‌সেন এ ঘটনার সত‌্যতা নি‌শ্চিত ক‌রে ব‌লেন ২১ মে নোয়ারাই গ্রা‌মের ইদ্রিস আলীর পুত্র আমির আলী আবেদ‌নের প‌রি‌প্রেক্ষি‌তে সি‌মেন্ট কারখানার না‌মে ৬শত টাকার পে অডার ইন্স‌্যু করা হয়। এ পে অডার‌কে জাল ক‌রে ৬‌ কো‌টি
টাকা বা‌নি‌য়ে‌ছে। এ ঘটনাটি আমা‌র ব‌্যাং‌কে  অবগত ক‌রে‌ছেন এম‌ডি।

সা‌বেক ছাতক সিমেন্ট কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেপাল কৃষ্ণ হাওলাদার সম্পা এন্টারপ্রাইজ ও হানিফ এন্টারপ্রাইজের ভুয়া ড্রাফেট ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন ও দুদকের দা‌য়ের করা দু‌টি মামলা সি‌লে‌টের আদাল‌তে বিচারাধীন র‌য়ে‌ছে। বিএমআরই  প্রজেক্টের প‌রিচালক ও সি‌মেন্ট কারখানার এম‌ডি আবদুর রহমান বাদশা তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গত ২৫ মে,টেন্ডা‌রে ৮‌টি প্রতিষ্টান অংশ গ্রহন ক‌র‌লে ও  তা‌দের ম‌ধ্যে স‌বোর্চ্চ দরদাতা নিবা‌চিত হ‌য়ে‌ছে বিল্লাল এন্টারপ্রাইজ। এনআর‌বিসি ব‌্যাং‌কের ৬শত টাকার ড্রাফট‌কে ৬‌কো‌টি টাকা বা‌নি‌য়ে দরপত্র বা‌গি‌য়ে নেয়ার চেষ্টা ক‌রে‌ছি‌লো।এ ঘটনায় ব‌্যাংক ড্রাফট জা‌লিয়া‌তি ঘটনায় সি‌ন্ডি‌কেট চ‌ত্রেুর বিরু‌দ্ধে মামলা করার প্রস্ত‌তি চল‌ছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

খুলনায় জলবায়ু ঝুঁকিকে মাথায় রেখে নগর ব্যবস্থাপনা সাজানো হবে:পরিকল্পনায় বুয়েট

এনআর‌বিসি ব‌্যাং‌ক ৬শ টাকার ড্রাফট‌কে ৬‌ কো‌টি টাকা দেখি‌য়ে‌ছে

Update Time : ০২:১৯:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

ছাতক সিমেন্ট কারখানা যেন দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত এ কারখানার অভ্যন্তরীণ এসব অনিয়ম-দুর্নীতি চলছেই। একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভুয়া কাগজপত্রে ৬‌ কো‌টি টাকার ভুয়া ব্যাংক ড্রাফট জা‌লিয়া‌তির ক‌রে সবোচ্চ দরদাতা নিবা‌চিত হ‌য়ে‌ছেন। এ মহা জা‌লিয়া‌তি ও ভুয়া ব‌্যাংক ড্রাফেট সঙ্গে সি‌মেন্ট কারখানার একা‌ধিক কর্মকতা ও এনআর‌বিসি ব‌্যাং‌কের ম‌্যা‌নেজার জ‌ড়িত থাকার অ‌ভি‌যোগ উঠে‌ছে।  এ ঘটনায় সর্বত্র ব্যাপক সামা‌জিক যোগা‌যোগ ফেইসবু‌কের মাধ‌্যমে তোলপাড় ঝড় বইছে।

সিসিএল এর পুরাতন ওয়েট প্রসেস কারখানার অব্যবহৃত -অকেজো চিহ্নিত বিভিন্ন স্থাপনা সহ বিভিন্ন পয়েন্টের স্ক্যাপ মালামাল ১ (এক) লটে (যেখানে যে অবস্থায় আছে) তা বিক্রয়ের দরপত্র প্রকাশ করা হয়। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সিমেন্ট প্রস্তুতকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছাতক সিমেন্ট কারখানায় সংঘটিত আবা‌রো ও  ব‌্যাং‌ক ড্রাফট জা‌লিয়া‌তি ও মহা দুর্নীতির একটি চিত্র ফুটে উঠেছে কারখানায়। গত ২৫ মে রোববার বিকা‌লে আবা‌রো ও সি‌মেন্ট কারখানায় এ দরপ‌ত্রে ব‌্যাং‌কের ভুয়া ড্রাফটের মহা জা‌লিয়া‌তির ঘটনা ঘ‌টে।

জানা যায়,ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পুরাতন প্রজেক্টের মালামাল,বিভিন্ন স্থাপনা,যেখানে যে অবস্থায় আছে স্ক্যাপ মালামাল বিক্রির টেন্ডার গত ১০  মার্চ  সিমেন্ট কারখানার টেন্ডার কমিটি, কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সন্মুখে টেন্ডার বক্স খোলা হয়। এ কাজে ৭১ টি দরপত্র বিক্রি হলেও জমা পড়েছেন  মাত্র ৩ টি দরপত্র। এই ৩ টি দরপত্রের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা হয়ে‌ছেন কিশোরগঞ্জ-ভৈরবের মেসার্স মমিনুল হক ৫৯ কোটি ৩ লক্ষ ৪৪ হাজার ৬ শত ৬৫ টাকার। এ প্রতিষ্ঠান ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার জানানত দিয়ে ৪৮ কোটি টাকা দর দাখিল করেন। দ্বিতীয় হয়েছেন মেসার্স বিছমিল্লাহ ট্রেডার্স,সোনালী চেলা,এ প্রতিষ্ঠান ৪৬ কোটি টাকা দর দাখিল করেছি‌লেন। তৃতীয় দরদাতা হয়েছেন মেসার্স শরাফত এন্ড সন্স,নোয়ারাই বাজার, এ প্রতিষ্ঠান ২৪ কোটি টাকা দর দাখিল করেন।

ছাতক সিমেন্ট কোম্পানীর বিক্রয় পুনঃ দরপত্র আহবান করে‌ছেন গত ৫ মে। সর্বোচ্চ দরদাতা বিল্লাল এন্টারপ্রাইজের  ৬ শত টাকার  পে- অর্ডারকে এনআরবিসি ব‌্যাং‌কের ছাতক শাখার দুনী‌তিবাজ ম‌্যা‌নেজারকে ম‌্যা‌নেজ ক‌রে ছয় কো‌টি টাকা ভুয়া ড্রাফট তৈ‌রি কর‌ছেন। দরপত্রে অংশ গ্রহণকারী ৮ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন,বিল্লাল এন্টারপ্রাইজ ৭৫ কোটি ৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা।

দ্বিতীয় দরদাতা নির্বাচিত হন বিছমিল্লাহ- সোনালী চেলা ইঞ্জিনিয়ারিং  ৭১ কোটি ১ লক্ষ টাকা। ৩ য় দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন মেসার্স রাকিব হাসান,তিনি দর দাখিল করেন ৬৯ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। ৪র্থ হলেন কর্ণফুলী রিভার্স ট্রান্সপোর্ট। তারা দর দাখিল করেন ৬৩ কোটি ১৬ লক্ষ ৫ শ ৫৫ টাকা। এছাড়া শহীদ ট্রেডার্স ৬১ কোটি টাকা,রাব্বি এন্টারপ্রাইজ ৫৯ কোটি,৯৫ লক্ষ ৯৯ হাজার টাকা,সালেহ এন্ড ব্রাদার্স ৫১ কোটি টাকা। মা আয়রণ পয়েন্ট ৪৯ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার দরপত্র  দাখিল করেছেন।

২০১৮ সা‌লে তিনি বিনা টেন্ডারে ৩৫ লাখ টাকায় কারখানার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিক্রি করেছিলেন। পরে এলাকাবাসীর প্রতিবাদের মুখে টেন্ডারের মাধ্যমে তা আড়াই কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়। ২০১৮ সা‌লে এক বছরে ভারত থেকে আসা প্রতি টন ১৮শ’ টাকার চুনাপাথর খোলাবাজারে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে কারখানার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আলোচ্য এই কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেট। গভীর অনুসন্ধান চালানো হলে ছাতক সিমেন্ট কারখানার আরও অনেক দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে গড়ে উঠছে স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেট এবং সেই সিন্ডিকেট নানা কারসাজিতে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। এসব সিন্ডিকেটের চোখে প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের কোনো মূল্য নেই। প্রয়োজনে তারা নিজেদের সামান্য স্বার্থের জন্য প্রতিষ্ঠানের বিশাল ক্ষতি করতেও প্রস্তুত। এ ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে- ‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’। ছাতক সিমেন্ট কারখানা এ দেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেশের অবকাঠামো নির্মাণে এ শিল্পের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। ২০১৮ সা‌লে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সেখানে। কমিটি দুটি প্রভাবমুক্ত অবস্থায় নিরপেক্ষভাবে প্রতিবেদন উপস্থাপন কর‌তে পা‌রে‌নি। ২০১৭ সা‌লে ১৩ ডিসেম্বর ছাতক পূবালী ব্যাংকের দেয়া মাসিক হিসাব বিবরণীতে এ জালিয়াতির ঘটনায় কারখানার হিসাব কর্মকর্তা রেজাউল করিম ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করে। এতে জাল ক্রেডিট ভাউচার দিয়ে কারখানার ৯২ লাখ টাকার সিমেন্ট তোলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। জানা গেছে, সম্পা ও হানিফ এন্টারপ্রাইজের নামে ভুয়া ৭টি ভাউচারে ৯২ লাখ টাকা ছাতক পূবালী ব্যাংকে পেমেন্ট দেখানো হলেও এগুলো ছিল জাল। পরে কারখানা ও ব্যাংক হিসাবে গরমিলের জন্য এ ঘটনার ব্যাপারে অধিকতর তদন্তে ধরা পড়ে।

সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংক ঢাকার একটি শাখায় সম্পা ও হানিফ এন্টারপ্রাইজের দেয়া ২ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ভুয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে ধমক দিয়ে ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা পরিশোধের বিষয়টিও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেন জ‌নৈক প‌রিচালক। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে কারখানার  বিএমআরই প্রজেক্টের শীর্ষ কর্মকর্তা বাদশা,সা‌বেক এম‌পি মুহিবুর রহমান মা‌নিক,সা‌বেক সি‌বিএ শ্রমিকলী‌গের সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সহ সভাপ‌তি আব্দুল কদ্দছু সহ কারখানার হিসাব বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তার সি‌ন্ডি‌কেট আছে। এ ঘটনায় ছাতক সিমেন্ট কারখানার হিসাব কর্মকর্তা আতিকুল ইসলামসহ ৪ জনকে শোকজ করা হয়েছে বলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেপাল কৃষ্ণ হাওলাদার জানান। এসব হাতিয়ে নেয়া ৯২ লাখ টাকার ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ হয়েছে বলেও দাবি করেন।  জানা গেছে, কেপিএম থেকে দুর্নীতির অভিযোগে বদলিকৃত জনৈক কর্মকর্তা কারখানার লুটপাটের মূল হোতা বলে স্থানীয়রা জানান। এ ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় ছাতক সিমেন্ট কারখানার রোপওয়ের বিভাগীয় প্রধান মাহবুব এলাকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বিসিআইসি।

এটিমের তদন্তে জালিয়াতিসহ লুটপাটের ঘটনায় জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে আবদুর রহমান বাদশার নাম চলে আসে। একটি সূত্র জানায়, প্রজেক্টের ডিপিডি আবদুর রহমান বাদশা কারখানার বড় ধরনের লুটপাট, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বিনা টেন্ডারে মাত্র ৩৫ লাখ টাকায় কারখানার পাওয়ার প্ল্যান্ট বিক্রি করেছিল। পরে এলাকাবাসীর প্রতিবাদের মুখে টেন্ডার দিয়ে এটি আড়াই কোটি টাকা বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া গত ১ বছরে কারখানার নামে ভারত থেকে আসা প্রতি টন ১৮শ’ টাকার চুনাপাথর খোলাবাজারে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে কারখানার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বাদশাসহ একটি সিন্ডিকেট। এভাবে নতুন বিএমআরই প্রজেক্টের উত্তোলিত ১৩ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১ কোটি টাকার কাজ দেখিয়ে ১২ কোটি টাকা লাপাত্তা করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। এ ব্যাপারে ছাতক সিমেন্ট কারখানার শ্রমিক ইউনিয়ন বি- ৮০ এর সভাপতি মোঃ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক শফি উদ্দিন এ ঘটনার সত‌্যতা নি‌শ্চিত ক‌রে ব‌লে এনআর‌সি ব‌্যাংক ড্রাফট ভুয়া ও জাল ব‌লে এম‌ডি তা‌দের‌কে জানান।

এব‌্যাপা‌রে এনআর‌বি‌সি ছাতক শাখার ম‌্যা‌নেজার সাকাতওয়াত হো‌সেন এ ঘটনার সত‌্যতা নি‌শ্চিত ক‌রে ব‌লেন ২১ মে নোয়ারাই গ্রা‌মের ইদ্রিস আলীর পুত্র আমির আলী আবেদ‌নের প‌রি‌প্রেক্ষি‌তে সি‌মেন্ট কারখানার না‌মে ৬শত টাকার পে অডার ইন্স‌্যু করা হয়। এ পে অডার‌কে জাল ক‌রে ৬‌ কো‌টি
টাকা বা‌নি‌য়ে‌ছে। এ ঘটনাটি আমা‌র ব‌্যাং‌কে  অবগত ক‌রে‌ছেন এম‌ডি।

সা‌বেক ছাতক সিমেন্ট কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেপাল কৃষ্ণ হাওলাদার সম্পা এন্টারপ্রাইজ ও হানিফ এন্টারপ্রাইজের ভুয়া ড্রাফেট ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন ও দুদকের দা‌য়ের করা দু‌টি মামলা সি‌লে‌টের আদাল‌তে বিচারাধীন র‌য়ে‌ছে। বিএমআরই  প্রজেক্টের প‌রিচালক ও সি‌মেন্ট কারখানার এম‌ডি আবদুর রহমান বাদশা তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গত ২৫ মে,টেন্ডা‌রে ৮‌টি প্রতিষ্টান অংশ গ্রহন ক‌র‌লে ও  তা‌দের ম‌ধ্যে স‌বোর্চ্চ দরদাতা নিবা‌চিত হ‌য়ে‌ছে বিল্লাল এন্টারপ্রাইজ। এনআর‌বিসি ব‌্যাং‌কের ৬শত টাকার ড্রাফট‌কে ৬‌কো‌টি টাকা বা‌নি‌য়ে দরপত্র বা‌গি‌য়ে নেয়ার চেষ্টা ক‌রে‌ছি‌লো।এ ঘটনায় ব‌্যাংক ড্রাফট জা‌লিয়া‌তি ঘটনায় সি‌ন্ডি‌কেট চ‌ত্রেুর বিরু‌দ্ধে মামলা করার প্রস্ত‌তি চল‌ছে।