বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে গত ২১ জুলাই নিহত হন ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৫)। দেলোয়ার মারা যাওয়ার ৪ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো কান্না থামেনি ৬৯ বছর বয়সী তাঁর মা বৃদ্ধা জিন্নাতুন নেছার। বাড়ির পাশে ছেলের কবরের পাশে ছুটে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
৫ ছেলের মধ্যে দেলোয়ার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল থাকায় বৃদ্ধ বয়সে ঢাকায় ছেলের কাছেই থাকতেন স্বামীহারা জিন্নাতুন নেছা। খাওয়া-দাওয়া ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে মায়ের পুরো খরচ চালাতেন ছেলে দেলোয়ার। কিন্তু পুলিশের গুলিতে ছেলে দেলোয়ার নিহত হওয়ায় এখন ভোলায় দিনমজুর ছেলে আয়োরের কাছে থাকেন তিনি। অর্থের অভাবে কোনো মতে ৩ বেলা ভাত থেকে পারলেও নিয়মিত ওষুধ খেতে পারেন না।
এদিকে গত ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বর পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হলে তাকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তার পেটে অস্ত্রপাচার করা হয়। এরপরও তাকে বাঁচানো যায়নি। ৩ দিন হাতপালের আইসিইউতে থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আনোয়ার। চিকিৎসায় প্রায় ৪ লাখ টাকার বেশী খরচ করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। দেলোয়ার চলে গেলেও পরিবারের কাঁধে তার রেখে যাওয়া প্রায় ৫ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। এটি নিয়েই দুঃশ্চিন্তায় রয়েছে নিহত দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বেগম।
নিহত দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বেগম বলেন, তার স্বামী গত ১৯ আগস্ট বিকাল ৪টার দিকে একটি কাজে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে যায়। পরে সেখানকার গোল চত্তরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন। এ অবস্থায় তার তলপেটে পুলিশের ৩টি গুলি লাগে গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে একে একে ৩টি হাসপাতালে নিলেও কোথাও কেউ তাকে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি।
এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার স্বামী দেলোয়ারে। পরে তাকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। ওই দিন রাতেই তার পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু ২১ তারিখ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরে তার মরদেহ ওই দিন সন্ধ্যার পর ভোলা সদরের গ্রামের বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
লিজা আরো বলেন, তার স্বামীর হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ, অপারেশন, মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে ভোলায় আনাসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৪ লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে। পুরো টাকাই ধার দেনা করে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এখন সেই টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন সেটি নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি দেলোয়ারের ফার্নিচারের দোকানটি ছেড়ে দিয়েছেন।
বর্তমানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাব্বি হাসান (১৩), ৬ বছরের মেয়ে হাসনুর ও ১৮ মাস বয়সী ছেলে হোসাইনকে নিয়ে আর্থিক সংকটে রয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী থেকে মাত্র ১ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন তিনি। এছাড়াও আরে সরকারি বা বেসরকারি কোনো অনুদান পাননি তিনি। তাই সরকারিভাবে দেলোয়ারে ঋণ পরিশোধ ও সংসার চালানোর মতো ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে দেলোয়ারের মা জিন্নাতুন নেছা বলেন, তার ৫ ছেলের মধ্যে দেলোয়ার ছিল ৪ নম্বর। প্রায় ২৬ বছর আগে দেলোয়ারের বাবা সুলতান আহমেদ মাল আরেকটি বিয়ে করেন। তিনি শ্বশুরের বাড়িতে থেকে অনেক সংগ্রাম করে ছেলেদের বড় করেছেন। একটু বড় হওয়ার পর দেলোয়ার ঢাকায় গিয়ে ফার্নিচারের দোকানে কাজ নেয়। গত কয়েক বছর আগে মিরপুর-১২ নম্বরে স্টান হাউজিং এলাকায় নিজেই একটি ছোটখাটো ফার্নিচারের দোকান দেয় এবং স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
তিনি সেখানে থাকতেন। ছেলে মধ্যে দেলোয়ারই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ছিলো। অন্য ছেলেরা দিনমজুর, জেলে, কাঠমিস্ত্রি ও কৃষি কাজ করে কোনো মতে সংসার চালায়। তাই দেলোয়ারই তার দেখভাল করতেন। তার শরীরে নানাবিধ রোগে বাসা বেঁধেছে। ছেলে মারা যাওয়ায় ওষুধ কিনেও খেতে পারছেন না। তার আদরের ছেলেকে কেন হত্যা করলো ? এখন কে তাকে ওষুধ কিনে দিবে, কার কাছে থাকবেন তিনি এসকল কথা বলেই অঝড়ে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা জিন্নাতুন নেছা। তিনি এ হত্যকান্ডের বিচার দাবি করেন।