Dhaka ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুপেয় পানির অভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোলার চরাঞ্চলের নারী-শিশুরা

চারদিকে নদী বেষ্টিত দ্বীপজেলা ভোলা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে ভোলা একটি। জলবায়ুর প্রভাবে ভোলার চরাঞ্চলে সুপেয় পানির উৎস কমে যাওয়ায় সেখানে বসবাসকারীরা অনিরাপদ পানি-পান ও ব্যবহারের ফলে নানান রোগে আক্রান্তসহ রয়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। চলমান শুষ্ক মৌসূমে সুপেয় পানির সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রায়ই জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে ডুবে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। কমে গেছে সুপেয় পানির উৎস, বিপাকে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ। এ জেলার মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট-বড় অন্তত ২০টি চরে বসবাস করেন অন্তত ২ লক্ষাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। তবে সেখানে অধিকাংশ নারী ও শিশুরা ভুগছেন স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায়।

জানা গেছে, ভোলা সদর উপজেলার বিচ্ছিন্ন ভোলার চর, কাচিয়া মাঝেরচর, চটকিমারা। দৌলতখানের নেয়ামতপুর চর, সৈয়দপুর, মদনপুর, চর বৈরাগী; তজুমদ্দিন উপজেলার চর জহিরউদ্দিন, চর মোজাম্মেল, চর নাসরিন। মনপুরা উপজেলার কলাতলী চর, ঢালচর চর, নিজাম চর, সামসুদ্দিন। চরফ্যাশন উপজেলার চর ফকিরা, চর লিউনিল, চর নিজাম, পূর্ব ঢালচর, ঢালচর, চর পাতিলা, কুকরি মুকরি। লালমোহন উপজেলার চর কচুয়াসহ জেলার অন্তত ২০টি চরাঞ্চলে বসবাসকারী রয়েছেন ২ লক্ষাধিক। সুপেয় পানির অভাবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন চরের নারী-শিশুরা। এসব চরে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নেই কার্যকরী কোনো উদ্যোগ।

সরেজমিনে ভোলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের চর বৈরাগীতে গিয়ে জানা গেছে, সেখানে বসবাস করেন প্রায় ২ হাজার মানুষ। এসব মানুষের সুপেয় পানির জন্য রয়েছে মাত্র ৮টি গভীর নলকূপ (টিউবওয়েল)। তার মধ্যে ২টি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে গত ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বাকি ৬টির মধ্যে দু-একটি প্রায় নষ্ট। নারীরা যেসব বদ্ধ পুকুরের পানি দিয়ে রান্না-ধোয়ামোছার কাজ করেন সেসব জলাশয়ে গবাদিপশু গোসল করানো হয়। একই পুকুর থেকে পানি বাড়িতেও নিয়ে যাচ্ছেন তারা। কমবেশি একই চিত্র সবগুলো চরে।

এতে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও জন্ডিস ও চর্মরোগ এসব চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। চরবাসী যেকোনো অসুখে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান হাতের কাছের কবিরাজ ও হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। এতে হীতে বিপরীত হচ্ছে। একদিকে তাদের অর্থনৈতিক সংকট অন্যদিকে টলারযোগে যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ কষ্টসাধ্য। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে কবিরাজের চিকিৎসা নেন বলে জানান তারা। তবে দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

খালের সঙ্গে যুক্ত ছোট একটি পুকুর থেকে কলস ভরে পানি ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন ৩ সন্তানের জননী রাবেয়া বেগম। তিনি চর বৈরাগীর বাসিন্দা। তার স্বামী ও দুই ছেলে মেঘনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই পানি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি দুপুরে ভাত-তরকারি রান্না করার জন্য। আরও দুই কলস নিয়েছি। কল অনেক দূরে তাই পুকুর থেকেই ঘরে পানি নিয়ে যাচ্ছি। ঘরে ফিটকিরি আছে, পানিতে ফিটকিরি দেব। তাছাড়া কলে তেমন পানি ওঠে না। মাঝেমধ্যে কিছুটা নোনা পানি ওঠে।

তিনি আরও জানান, পানিতে ফিটকিরি দিলে পানি কিছুটা নিরাপদ হলেও নোনা তো আর যায় না। বাধ্য হয়েই পরিবারের সবাই এ পানি খেতে হয়। ছোডো (ছোট) পোলাডার চর্মরোগ দেখা দিছে। এই হানে একজন কবিরাজ আছে, তার থেকে ওষুধ নিয়ে পোলাডার শরীরে দেয়ার পর পুরো শরীলডায় ফোঁসকা পড়েছে। ডাক্তারের কাছে কেনো নেননি জানতে চাইলে তিনি আরও জানান, আমরা গরিব মানুষ। ডাক্তারের কাছে গেলেই মেলা টেয়ার (টাকা) ধাক্কা। তাই নেয়া হয়নি। পোলাডায় মেলা দিন ভুগছে।

চর বৈরাগীর বাসিন্দা মো. মালেকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাঙ্গে মাছ ধইরা সংসার চালাই। গাঙ্গে জোয়ার-ভাটার সময় নোনা পানির মধ্যে নাইম্মা (নেমে) জাল টাইন্না মাছ ধরি। নোনা পানিতে থাকতে থাকতে পুরো শরীরে চর্মরোগ দেহা দেছে। কিচ্ছু করার নাই। স্ত্রীসহ সংসারে ৩ মেয়ে খাউইন্না। দেশে কোনো ঘরবাড়ি ও জায়গা জমিন কিচ্ছুই নাই, তাই এইখানেই থাহি। আমাগো এইহানে খাওয়ার পানির (সুপেয়) অভাব। কল বেশিরভাগ সময় নষ্ট হয়ে থাকে। এতে আমরা প্রয়োজনমত পানি পাই না। পানির তৃষ্ণা ধরলে যেখানে পানি পাই সেখান থেকেই খাই।

চরের বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন বলেন, পরিবার লইয়া এ বিচ্ছিন্ন চরে থাহি। পানির চেয়েও বেশি সমস্যা চিকিৎসার, কোনো চিকিৎসা পাই না। অসুখ ওইলে আমরা তো আর বুঝি না কোনডা কি রোগ, কেন ওইছে। চরে কারও অসুখ ওইলে যে দ্রুত তারে নদীর ওপার লইয়া যামু হেইডাও পারি না। তাই সরকারের কাছে সুপেয় পানির সংকট নিরসনসহ চরের মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাইদুর রহমান শামিম বলেন, চরাঞ্চলে বসবাসকারী অনেক রোগী পাই যারা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের ত্বক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসার আগে এসব রোগীরা স্থানীয় কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নেন। কবিরাজ তাদেরকে নিজের বানানো বিভিন্ন ওষুধ দেন। এতে হীতে বিপরীত হয়। রোগ নির্ণয়ের দক্ষতা তাদের নেই।

তিনি আরও বলেন, সুস্থ থাকতে সুপেয় পানি পান ও ব্যবহারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ পানি সরাসরি পান থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধ করে পান করার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া চরাঞ্চলে বসবাসকারীদের চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগ দেখা দিলে দ্রুত স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।

ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে ভোলার চরাঞ্চলে সুপেয় পানি কমে যাচ্ছে। এতে মানুষসহ জীব-বৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ভোলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে জনসংখ্যার বিপরীতে খাবার পানির উৎস্য নলকূপের পরিমাণ খুবই নগন্য। ফলে সেখানকার বসবাসকারীরা নদী-খালের পানি ব্যবহার করছে। এ কারণে দিনদিন চরাঞ্চলে মানুষের ডায়রিয়া, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগের রোগী বাড়ছে। বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহারের জন্য তাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সচেতন করা হবে। চরাঞ্চলগুলোতে এখনো পুরোপুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছি।

ভোলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশল এসএম মাহামুদুর রহমান বলেন, ভোলার চরাঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট কাটানোর জন্য চেষ্টা করছি। আমরা প্রতিবছর গভীর নলকূপ স্থাপন করি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমাদের প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ১২টি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে। এতে চরাঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট কেটে যাবে বলে জানান তিনি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

আলোচিত

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে পরিত্যক্ত লোহা বিক্রি

সুপেয় পানির অভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভোলার চরাঞ্চলের নারী-শিশুরা

Update Time : ০৫:৫৬:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

চারদিকে নদী বেষ্টিত দ্বীপজেলা ভোলা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে ভোলা একটি। জলবায়ুর প্রভাবে ভোলার চরাঞ্চলে সুপেয় পানির উৎস কমে যাওয়ায় সেখানে বসবাসকারীরা অনিরাপদ পানি-পান ও ব্যবহারের ফলে নানান রোগে আক্রান্তসহ রয়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। চলমান শুষ্ক মৌসূমে সুপেয় পানির সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রায়ই জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে ডুবে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। কমে গেছে সুপেয় পানির উৎস, বিপাকে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ। এ জেলার মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট-বড় অন্তত ২০টি চরে বসবাস করেন অন্তত ২ লক্ষাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। তবে সেখানে অধিকাংশ নারী ও শিশুরা ভুগছেন স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায়।

জানা গেছে, ভোলা সদর উপজেলার বিচ্ছিন্ন ভোলার চর, কাচিয়া মাঝেরচর, চটকিমারা। দৌলতখানের নেয়ামতপুর চর, সৈয়দপুর, মদনপুর, চর বৈরাগী; তজুমদ্দিন উপজেলার চর জহিরউদ্দিন, চর মোজাম্মেল, চর নাসরিন। মনপুরা উপজেলার কলাতলী চর, ঢালচর চর, নিজাম চর, সামসুদ্দিন। চরফ্যাশন উপজেলার চর ফকিরা, চর লিউনিল, চর নিজাম, পূর্ব ঢালচর, ঢালচর, চর পাতিলা, কুকরি মুকরি। লালমোহন উপজেলার চর কচুয়াসহ জেলার অন্তত ২০টি চরাঞ্চলে বসবাসকারী রয়েছেন ২ লক্ষাধিক। সুপেয় পানির অভাবে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন চরের নারী-শিশুরা। এসব চরে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নেই কার্যকরী কোনো উদ্যোগ।

সরেজমিনে ভোলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের চর বৈরাগীতে গিয়ে জানা গেছে, সেখানে বসবাস করেন প্রায় ২ হাজার মানুষ। এসব মানুষের সুপেয় পানির জন্য রয়েছে মাত্র ৮টি গভীর নলকূপ (টিউবওয়েল)। তার মধ্যে ২টি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে গত ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বাকি ৬টির মধ্যে দু-একটি প্রায় নষ্ট। নারীরা যেসব বদ্ধ পুকুরের পানি দিয়ে রান্না-ধোয়ামোছার কাজ করেন সেসব জলাশয়ে গবাদিপশু গোসল করানো হয়। একই পুকুর থেকে পানি বাড়িতেও নিয়ে যাচ্ছেন তারা। কমবেশি একই চিত্র সবগুলো চরে।

এতে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও জন্ডিস ও চর্মরোগ এসব চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। চরবাসী যেকোনো অসুখে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান হাতের কাছের কবিরাজ ও হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। এতে হীতে বিপরীত হচ্ছে। একদিকে তাদের অর্থনৈতিক সংকট অন্যদিকে টলারযোগে যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ কষ্টসাধ্য। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে কবিরাজের চিকিৎসা নেন বলে জানান তারা। তবে দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

খালের সঙ্গে যুক্ত ছোট একটি পুকুর থেকে কলস ভরে পানি ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন ৩ সন্তানের জননী রাবেয়া বেগম। তিনি চর বৈরাগীর বাসিন্দা। তার স্বামী ও দুই ছেলে মেঘনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই পানি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি দুপুরে ভাত-তরকারি রান্না করার জন্য। আরও দুই কলস নিয়েছি। কল অনেক দূরে তাই পুকুর থেকেই ঘরে পানি নিয়ে যাচ্ছি। ঘরে ফিটকিরি আছে, পানিতে ফিটকিরি দেব। তাছাড়া কলে তেমন পানি ওঠে না। মাঝেমধ্যে কিছুটা নোনা পানি ওঠে।

তিনি আরও জানান, পানিতে ফিটকিরি দিলে পানি কিছুটা নিরাপদ হলেও নোনা তো আর যায় না। বাধ্য হয়েই পরিবারের সবাই এ পানি খেতে হয়। ছোডো (ছোট) পোলাডার চর্মরোগ দেখা দিছে। এই হানে একজন কবিরাজ আছে, তার থেকে ওষুধ নিয়ে পোলাডার শরীরে দেয়ার পর পুরো শরীলডায় ফোঁসকা পড়েছে। ডাক্তারের কাছে কেনো নেননি জানতে চাইলে তিনি আরও জানান, আমরা গরিব মানুষ। ডাক্তারের কাছে গেলেই মেলা টেয়ার (টাকা) ধাক্কা। তাই নেয়া হয়নি। পোলাডায় মেলা দিন ভুগছে।

চর বৈরাগীর বাসিন্দা মো. মালেকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাঙ্গে মাছ ধইরা সংসার চালাই। গাঙ্গে জোয়ার-ভাটার সময় নোনা পানির মধ্যে নাইম্মা (নেমে) জাল টাইন্না মাছ ধরি। নোনা পানিতে থাকতে থাকতে পুরো শরীরে চর্মরোগ দেহা দেছে। কিচ্ছু করার নাই। স্ত্রীসহ সংসারে ৩ মেয়ে খাউইন্না। দেশে কোনো ঘরবাড়ি ও জায়গা জমিন কিচ্ছুই নাই, তাই এইখানেই থাহি। আমাগো এইহানে খাওয়ার পানির (সুপেয়) অভাব। কল বেশিরভাগ সময় নষ্ট হয়ে থাকে। এতে আমরা প্রয়োজনমত পানি পাই না। পানির তৃষ্ণা ধরলে যেখানে পানি পাই সেখান থেকেই খাই।

চরের বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন বলেন, পরিবার লইয়া এ বিচ্ছিন্ন চরে থাহি। পানির চেয়েও বেশি সমস্যা চিকিৎসার, কোনো চিকিৎসা পাই না। অসুখ ওইলে আমরা তো আর বুঝি না কোনডা কি রোগ, কেন ওইছে। চরে কারও অসুখ ওইলে যে দ্রুত তারে নদীর ওপার লইয়া যামু হেইডাও পারি না। তাই সরকারের কাছে সুপেয় পানির সংকট নিরসনসহ চরের মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাইদুর রহমান শামিম বলেন, চরাঞ্চলে বসবাসকারী অনেক রোগী পাই যারা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের ত্বক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসার আগে এসব রোগীরা স্থানীয় কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নেন। কবিরাজ তাদেরকে নিজের বানানো বিভিন্ন ওষুধ দেন। এতে হীতে বিপরীত হয়। রোগ নির্ণয়ের দক্ষতা তাদের নেই।

তিনি আরও বলেন, সুস্থ থাকতে সুপেয় পানি পান ও ব্যবহারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ পানি সরাসরি পান থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধ করে পান করার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া চরাঞ্চলে বসবাসকারীদের চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগ দেখা দিলে দ্রুত স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনামূল্যে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।

ভোলার সিভিল সার্জন ডা. মনিরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে ভোলার চরাঞ্চলে সুপেয় পানি কমে যাচ্ছে। এতে মানুষসহ জীব-বৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। ভোলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে জনসংখ্যার বিপরীতে খাবার পানির উৎস্য নলকূপের পরিমাণ খুবই নগন্য। ফলে সেখানকার বসবাসকারীরা নদী-খালের পানি ব্যবহার করছে। এ কারণে দিনদিন চরাঞ্চলে মানুষের ডায়রিয়া, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগের রোগী বাড়ছে। বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহারের জন্য তাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সচেতন করা হবে। চরাঞ্চলগুলোতে এখনো পুরোপুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছি।

ভোলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশল এসএম মাহামুদুর রহমান বলেন, ভোলার চরাঞ্চলের সুপেয় পানির সংকট কাটানোর জন্য চেষ্টা করছি। আমরা প্রতিবছর গভীর নলকূপ স্থাপন করি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমাদের প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ১২টি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে। এতে চরাঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট কেটে যাবে বলে জানান তিনি।